জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুপ প্রভাব পড়েছে ব্রি-২৮ ধানে

জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুপ প্রভাব পড়েছে ব্রি-২৮ ধানে

গেল কয়েক বছর ধরেই বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুপ প্রভাব পড়ছে কৃষিতে। বিশেষ করে বন্যা আর খরার কবলে পড়ে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে দেশের সবচেয়ে বড় অর্থকরি ফসল বোরো ধান। চলতি বছরও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ব্রি-২৮ জাতের ধানে চিঁটা দেখা দিয়েছে। এতে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছেন হবিগঞ্জের কয়েক লাখ কৃষক। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্র নিয়ে দেখা দিয়েছে শঙ্কা।

তবে কৃষি বিভাগ বলছে- ক্ষতি কাটিয়েও চলতি বোরো মৌসুমে হবিগঞ্জ জেলা থেকে আড়াই হাজার কোটি টাকার বেশি চাল উৎপাদন হবে। যদিও জলবায়ু পরিবর্তন থেকে ফসল রক্ষায় দুই যুগ আগে উদ্ভাবিত ব্রি-২৮ ও ২৯ ধান থেকে সড়ে নতুন জাতের ধান চাষের পরামর্শ তাদের।

জানা গেছে, আগাম ফসল ঘরে তোলার সুবিধা এবং বাজারে সরু চালের চাহিদা বেশি থাকায় ব্রি-২৮ জাতের ধান চাষে ব্যাপক আগ্রহ হাওরের কৃষকদের। চলতি বছর হবিগঞ্জ জেলায় ১ লাখ ২২ হাজার ৫৭৫ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে। যার ২৫ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় ৩ হাজার ৬৪৩ হেক্টর জমিতে চাষ হয়েছে ব্রি-২৮ জাতের ধান।

এই ধান চাষে যেমন সুবিধা রয়েছে তেমন অসুবিধাও রয়েছে অনেক। জলবায়ু পরিবর্তন আর অনেক দিনের পুরনো জাতের ধান হওয়ায় এই ধান চাষে ক্ষতিগ্রস্থ হন কৃষকরা। বিশেষ করে ফ্লাওয়ারিংয়ের সময় স্বাভাবিক তাপমাত্রা না থাকলেই চিঁটাসহ নানা ধরণের রোগে আক্রান্ত হয় ব্রি-২৮ জাতের ধান।

চলতি মৌসুমে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুপ প্রভাবে হবিগঞ্জে ব্রি-২৮ ধানে ব্যাপকভাবে চিঁটা দেখা দিয়েছে। এতে ক্ষতির মুখে পড়েছেন জেলার কয়েক লাখ কৃষক। সারা বছরের হাড়ভাঙা পরিশ্রমের ফসল ঘরে তোলতে না পারায় দিশেহারা চাষিরা। বিশেষ করে লাখাই, বানিয়াচং ও আজমিরীগঞ্জের কৃষকরা বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন।

লাখাই উপজেলার স্বজনগ্রামের কৃষক মিন্টু দাস বলেন, ‘এ বছর আমি ১৪ কের ক্ষেতে ব্রি-২৮ ধান চাষ করেছি। অন্য বছর ১৪ কের ক্ষেতে সারাবছর খেয়েও ৭০ মন ধান বিক্রি করতে পারছি। এ বছর বেঁচাতো দূরের কথা, দুই মাসের খাওয়নও হইত না।’

‘শুধু আমার না। এই এলাকার সবার ২৮ ধান নষ্ট হয়ে গেছে। একটা লোক নাই যে কইতে পারব তার ২৮ ধান ভালো হইছে।’

বানিয়াচং উপজেলার দিঘলবাগ গ্রামের কৃষক মধু মিয়া বলেন, ‘যা যা করা লাগে সবই করছি। ক্ষেতে ধানও আইছে বেশি। কিন্তু ধানের ভেতরে চাউল নাই। যখন এই সমস্যা দেখা দিয়েছে তখনই কিটনাশকসহ বিভিন্ন ধরণে ওষুধ এনে দিছি। কিন্তু কোন কাজ হয়নি।’

কৃষক মো. নিজাম উদ্দিন বলেন, ‘ব্রি-২৮ জাতের ধানের ভাত খেতে সুস্বাদু। এছাড়া বাজারেও এই ধানের দাম বেশি। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে চৈত্র মাসেই এই ধান কাটা যায়। যে কারণে আমরা এই ধানটি চাষ করি। কিন্তু এ বছর এই ধান চাষ করে আমরা পথে বসে গেছি। আমরা ঋণ করে যে ধান চাষ করছি এখন সেই ঋষ দেয়ার ক্ষমতা আমাদের নাই।’

কৃষি বিভাগ বলছে- চলতি বোরো মৌসুমে হবিগঞ্জ জেলা থেকে ৫ লাখ ১৩ হাজার ৯৩ মেট্রিকটন চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। প্রতিকেজি ৫৫ টাকা দরে যার বাজার মূল্য ২ হাজার ৮২২ কোটি ১ লাখ ১৫ হাজার টাকা। তবে ব্রি-২৮ জাতের ধানে চিঁটা হওয়ার কারণে উৎপাদন কিছুটা সমার আশঙ্কা করছেন তারা।

হবিগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ নূর-ই আলম সিদ্দিকী বলেন- এ বছর হবিগঞ্জ জেলার বিভিন্ন এলাকায় ব্রি-২৮ ধানে চিঁটা হয়েছে বলে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা আমাকে জানিয়েছেন। দুটি কারণে এই সমস্যা দেখা দেয়। একটি হচ্ছে ব্লাস্ট রোগ এবং অপরটি দিনে অতিরিক্ত তাপমাত্রা ও রাতে ঠান্ডা থাকার কারণে হয়ে থাকে।’

‘যেগুলো ব্লাস্ট রোগে আক্রান্ত হয়েছে সেগুলো কিটনাশক দেওয়ার জন্য কৃষক ভাইদেও পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। আর যেগুলো আবহাওজনিত কারণে সমস্যা হয়েছে সেগুলোতে আমাদেও কিছু করার নেই। সেটি সম্পূর্ণ প্রকৃতির উপর নির্ভর করছে। এ বছর ফ্লাওয়ারিংয়ের সময় দিনে অতিরিক্ত গরমে ধানের ফুল শুকিয়ে নষ্ট হয়ে গেছে। যে কারণে চিঁটা সমস্যা দেখা দিয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘দুই যুগেরও আগে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্ট্রিটিউটের বিজ্ঞানীরা ব্রি-২৮ জাতের ধানের উদ্ভাবন করেন। এরপর থেকে এই ধানের প্রতি বেশি আগ্রহ চাষিদের। দীর্ঘদিনের পুরনো ধান হওয়ায় এই ধান বিভিন্ন ধরণের রোগে আক্রান্ত হয়।’

‘অনেক দিনের পুরনো ধান হওয়ায় পোকামাকড় আক্রমণ করলে ঔষধ এবং কীটনাশক প্রয়োগ করেও খুব ভালো ফল পাওয়া যায় না। একারণে কৃষকদেরকে ব্রি ধান-২৮ চাষাবাদে নিরুৎসাহিত করা হয়। এর পরিবর্তে ব্রি ধান-৮৮, ব্রি ধান-৯২, ব্রি ধান-৯৬ এবং ব্রি ধান-৮৯ চাষাবাদ করতে উৎসাহিত করা হচ্ছে। কিন্তু কৃষকরা নতুন জাতগুলোতে ভরসা রাখতে পারছেন না।’