প্রবাসে নিঃসঙ্গ ঈদ

প্রবাসে নিঃসঙ্গ ঈদ

‘ঈদ মানে আনন্দ, ঈদ মানে খুশি’ এ কথাটি প্রচলিত থাকলেও প্রবাসীদের ক্ষেত্রে তা একেবারেই ভিন্ন। বিশেষ করে গ্রিসে ঈদের আমেজ নেই বললেই চলে। কারণ একদিকে স্বজন ও পরিবারবিহীন ঈদ অন্যদিকে অনিয়মিতদের ধরপাকড় ও বিতাড়িত করার আতঙ্ক। সব মিলিয়ে হতাশা আর নিঃসঙ্গতায় দিনটি কেটেছে গ্রিস প্রবাসীদের।

প্রতি বছরে ঈদ আসলেই ১৫ থেকে ২০ দিন আগেই উদযাপনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়। নতুন জামা-কাপড় কেনা হয়। বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে যাওয়ার পরিকল্পনা করা হয়। ঈদের দিন ফজরের আজানের পর দলবেঁধে ছোটাছুটি করে গোসল সেরে সেমাই খেয়ে নতুন জামা-কাপড় পরে ঈদগাহ মাঠে গিয়ে সবাই একত্রে নামাজ আদায় করা হয়। এসব এখন আমাদের শুধুই স্মৃতি। প্রবাস জীবনে একের পর এক ঈদ আসে যায়, নিঃসঙ্গতার সঙ্গে।

প্রবাসে পরিবার-পরিজন ছাড়া দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনার পর এবার ৩য় বারের মতো ঈদ উদযাপন করছি। এখানে ঈদের কোনো আমেজ নেই। আরব দেশে ঈদে প্রবাসীদের ছুটি থাকলেও ইউরোপে কোনো ছুটি নেই। কাজের ফাঁকেই আমাদের ঈদ।

তবে এ বছর মে দিবসে ছুটি থাকায় অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। এ কারণে সবাই একসাথে ঈদের জামাতে নামাজ আদায় করার সুযোগ পেয়েছেন। এথেন্সে এবার খোলা মাঠে ঈদ জামাতের অনুমতি দেয়নি সরকার। তবে সরকারি জামে মসজিদ, আবু হুরায়রা মসজিদ, দারুল ইসলাম জামে মসজিদ, আল জব্বার মসজিদ, আল ফালাহ মসজিদ, দারুল আমান মসজিদ, মসজিদে জান্নাত, মসজিদে হজরত আয়েশা রাঃ, বায়তুল আমান জামে মসজিদ, মসজিদে হজরত উমর রাঃ, বাবরি মসজিদসহ বিভিন্ন মসজিদে ৪-৫ জামাতে নামাজ আদায় করেছেন বাংলাদেশিসহ বিভিন্ন দেশি মুসলমানরা।

এথেন্স সরকারি জামে মসজিদ ও মাঠে বিপুল সংখ্যক মুসলমান অভিবাসী জামাতে অংশ নেন। মাঠে বিভিন্ন দেশি নারী ও কিশোরীরা অংশগ্রহণ করেন। তবে গত ২-৩ দিন ধরে ফের ধরপাকড় শুরু হওয়ায় অনেকটা আতঙ্কে ঈদের জামাতে অংশ নিয়েছেন অনিয়মিতরা।

প্রাচীন সভ্যতার দেশ গ্রিসে বর্তমানে মানবেতর জীবনযাপন করছেন অনিয়মিত বাংলাদেশি অভিবাসীরা। এথেন্সে প্রতিনিয়তই চলছে অনিয়মিতদের ধরপাকড়। অনিয়মিত অভিবাসীদের নিজ দেশে ফেরত পাঠাতেও তোড়জোড় শুরু করেছে সরকার। প্রাচীন সভ্যতার পিঠস্থান খ্যাত এই দেশে বাংলাদেশিরা প্রতিনিয়তই বর্ণ-বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন।

গ্রিসে বসবাস করেন প্রায় ৩০ হাজারেরও বেশি বাংলাদেশি। গ্রিক সরকারের পরিসংখ্যান অনুযায়ী বৈধ অনুমতি নিয়ে দেশটিতে বসবাস করা বাংলাদেশিদের সংখ্যা প্রায় সাড়ে ১২ হাজার। এর বাইরে অনেকে রয়েছেন যাদের বসবাসের অনুমতি নেই বা আশ্রয় আবেদন বাতিল হয়েছে। এমনকি অনেকেই এখনো আশ্রয় আবেদনের সুযোগ পাননি।

গ্রিসের পশ্চিম মানোলাদায় বাস করেন উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাংলাদেশি শ্রমিক। তারা মূলত গ্রিক কৃষিখামারের সঙ্গে জড়িত। স্ট্রবেরি ও জয়তুন, মাল্টাসহ কৃষির বিভিন্ন খামারেই তাদের কাজ। গ্রিসে বসবাসরত শ্রমিকগণ গ্রিস ও বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখছেন। এমনকি করোনা মহামারির মধ্যেও তারা কঠোর পরিশ্রম করে গ্রিসের কৃষিতে অবদান রাখছেন।

এছাড়া রাজধানী এথেন্সেও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত রয়েছেন বাংলাদেশি শ্রমিকরা। এদিকে গেলো বছরের ডিসেম্বরে একটি চার্টার্ড ফ্লাইটে গ্রিস থেকে ১৯ জন বাংলাদেশিকে ঢাকায় ফেরত পাঠানো হয়। এরপর গত ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশ ও গ্রিসের মধ্যে জনশক্তি রপ্তানি সংক্রান্ত বিষয়ে সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে।

এ চুক্তিতে রয়েছে নতুন জনশক্তি রপ্তানি ও অনিয়মিতদের বৈধ করণের কথা। চুক্তির পর অভিবাসীদের মনে কিছুটা স্বস্তি ফিরেছিল, তারা ভেবেছিল হয়তো আর ফেরত পাঠানো হবে না। কিন্তু চুক্তির পরও গেলো মার্চ মাসে ৭ বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠানোর ঘটনায় আতঙ্কে রয়েছেন অনিয়মিতরা।

করোনা মহামারির দীর্ঘ ২ বছর পর এবারের রমজান মাসে বাংলাদেশি মুসলমানদের ব্যাপক তৎপরতা দেখা যায়। বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তি উদ্যোগে আয়োজন করা হয় ঈফতার মাহফিল এতে দলমত নির্বিশেষে উপস্থিত হন প্রবাসী বাংলাদেশিরা। বাংলাদেশ কমিউনিটিসহ বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মীরা উপস্থিত হন মাহফিলে।

তবে এদের এখানে বসবাসের অনুমতি রয়েছে আবার অনেকেই স্থায়ী বসবাস করছেন। কিন্তু পুলিশি আতঙ্কে সিংহভাগ অনিয়মিত বাংলাদেশিরা গ্রাম এলাকায় বা আড়ালেই রয়েছেন। তাদের মধ্যে নেই কোনো ঈদের আমেজ। হতাশায় দিন কাটছে অনিয়মিত বাংলাদেশিদের।

ঈদের দিন মন খারাপ হয়ে যায়। সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে কাউকে খুঁজে পাওয়া যায় না। তখন মনে পড়ে যায় চিরচেনা গ্রামে ঈদ উদযাপনের স্মৃতিগুলো। পরিবার আর আত্মীয় স্বজনবিহীন বিদেশের মাটিতে এভাবেই ঈদ কাটে নীরবে নিভৃতে। যাইহোক সবাইকে ঈদের শুভেচ্ছা। ঈদ মোবারক।