'বানিয়াচংবাসীর মন হাওরের মতো বিশাল'

'বানিয়াচংবাসীর মন হাওরের মতো বিশাল'
ইউএনও মাসুদ রানা।

করোনা মহামারির প্রাক্কালে ২০২০ সালের ১৮ জুন বানিয়াচংয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) হিসেবে যোগদান করেন মাসুদ রানা। গত এক বছরের যাত্রা কেমন ছিলো তা নিয়ে সম্প্রতি তিনি মুখোমুখি হয়েছেন জাগো সিলেটের। কথা বলেছেন বর্তমানে বিশ্বের বৃহত্তম গ্রাম হিসেবে পরিচিত এ উপজেলার নানা দিক নিয়ে।

সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক আজহার উদ্দিন শিমুল।

জাগো সিলেট : একটা কঠিন সময়ে আপনি যোগদান করলেন বানিয়াচংয়ে যাত্রার শুরুটা কেমন ছিলো?

মাসুদ রানা : করোনার কঠিন সময়ে আমি যোগদান করেছি সেটা সত্য। এখনো কঠিন সময়ে আছি৷ করোনা একটি অদৃশ্য শক্তি, যার বিরুদ্ধে আমরা যুদ্ধ করছি। পৃথিবীর মানবকূল আবার স্বাভাবিক হবে বলে বিশ্বাস করি। শুরু থেকেই স্বাধীনভাবে কাজ করে যাচ্ছি। বানিয়াচংয়ের মানুষ কাজের মাধ্যমে মূল্যায়ন করবে বলে প্রত্যাশা করি। আমি কথায় নয়, কাজে বিশ্বাসী৷ কাজ করতে ভালোবাসি, কাজ করেই যাই। পেছনে কে কি বললো সেটা বড় কথা নয়। আমি মানুষের জন্য কতটুকু করতে পারলাম সেটাই বড় কথা। আমি তো সারা জীবনের জন্য এখানে আসি নি, সারাজীবন তো আর ইউএনও থাকবো না। ভালো কাজই আমাকে বাঁচিয়ে রাখবে। আমার বাড়িও হাওরে, কাজও করছি হাওরে। তাই মনপ্রাণ উজাড় করে কাজ করছি। সবার সহযোগিতা পাচ্ছি সমানভাবে।

জাগো সিলেট : এক বছরের অধিক সময় আছেন এই উপজেলায়। এখানে কাজের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ কী?

মাসুদ রানা : এই বছরের ১৮ জুন আমার এক বছর পূর্ণ হয়েছে। এটা যেহেতু হাওর অধ্যুষিত এলাকা সেহেতু চ্যালেঞ্জ তো আছেই। চাইলেই আমি সকল ইউনিয়নে যেতে পারি না। বর্ষায় সময় নৌকা দিয়ে অনেক এলাকায় যেতে হয়। এখানে কাজ করার ক্ষেত্রে যোগাযোগ ব্যবস্থাটা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এলাকার মানুষজন খুব ভালো৷ বানিয়াচংবাসীর মন হাওরের মতো বিশাল।

জাগো সিলেট : স্থানীয় সাংসদ, উপজেলা পরিষদের ৩ চেয়ারম্যানসহ বিভিন্ন ইউনিয়নের জনপ্রতিনিধিরা আপনাকে কাজে কতটুকু সমন্বয় করেন?

মাসুদ রানা : তাঁরা অবশ্যই সমন্বয় করছেন। কারণ তাঁরা সরকারের অংশ, আমরাও সরকারের অংশ। আমাদের এখানে এখনো কোনো সমন্বয়ের অভাব দেখা যায় নি। আমরা একে অপরের সাথে সহযোগিতামূলক কাজ করি৷ আমাদের সাংসদ অত্যন্ত সজ্জন ব্যক্তি। তিনি খুবই সাপোর্টিভ। চেয়ারম্যান সাহেবও চমৎকার মানুষ। আমরা একসাথে কাজ করে যাচ্ছি।

প্রতিবেদকের সঙে কথা বলছেন ইউএনও মাসুদ রানা।

জাগো সিলেট : করোনা মোকাবেলায় আপনার উপজেলা প্রশাসন এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান কি কি করেছে?

মাসুদ রানা : আমরা হচ্ছি কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধি। সেই হিসেবে সরকার থেকে যখন যে সাহায্য আসে তা আমরা বিতরণ করি। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের কাছে আমরা বরাদ্দ পাঠিয়ে দেই। আমি নিজেও অনেক সময় দেই৷ করোনায় ক্ষতিগ্রস্তদের আমরা সর্বোচ্চভাবে সহায়তা প্রদান করে যাচ্ছি। তবে দুঃখের বিষয় হচ্ছে, স্থানীয় পর্যায়ে আমরা এমন কোনো দানবীর বা উদ্যোক্তা কাউকে পাই নি যে তাঁরা আমাদের মাধ্যমে সহায়তা দিবেন। আমার চোখে এখনো এমন কাউকে পড়ে নি। এনজিওগুলোরও তেমন কোনো কাজ আমার চোখে দৃশ্যমান হয় নি। দিলে সরকারই দিচ্ছে। কিন্তু সমালোচনা বা বড় বড় কথা সবাই বলতে পারে।

জাগো সিলেট : আপনারা কড়া লকডাউন শুরু হওয়ার পর থেকেই টহল দিচ্ছেন। মানুষকে কতটুকু আপনাদের বার্তা গ্রহণ করছে?

মাসুদ রানা : আমাদের এসিল্যান্ড সাহেব যেহেতু অসুস্থ সেহেতু আমাকেই অনেকটা করতে হচ্ছে৷ লকডাউনে অনেকেই চোর-পুলিশ খেলছে। মানুষজন কথা শুনছে কম। তবে অধিকাংশ মানুষেই মাস্ক ব্যবহার করছেন। একদিকে আমরা টহল দিচ্ছি, লোকজনকে বুঝাচ্ছি ঘরে থাকার জন্য। অন্যদিকে তাঁরা আমাদের পাহারা দিচ্ছেন। এই কয়েক দিনে আমার অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছে। চা বাঙালির সবচেয়ে প্রিয় খাবার এবং অবশ্যই সেটা দোকানের হতে হবে। তাঁদের দোকানে আড্ডা দিতে দেখা যায়। ভয়তো সবারই আছে তাই লট ভিত্তিক ক্রেতাকে দোকানে ঢুকিয়ে বাহিরে সিগনাল দেয়ার জন্য একজন দাঁড়িয়ে থাকে। আমাদের দেখলেই শাটার বন্ধ করে দেয়। সবকিছু বন্ধ থাকলেও ব্যাংকিং লেনদেন বেড়ে যাওয়ায় বাইরে বের হওয়ার অজুহাত অনেক ক্ষেত্রে বেড়ে গেছে। টহল কেমন হচ্ছে তা দেখতে কতিপয় উৎসুক জনতা ভিড় করছেন, তাঁরা সেনাবাহিনীকেও দেখতে বের হচ্ছেন। ব্যাপারটা এমন পর্যায়ে গেছে মনে হচ্ছে তাঁদের জীবনের দাম আমার কাছেই বেশী, দিনশেষে আমরাই ভালো না!

জাগো সিলেট : নিম্ন আয়ের মানুষরা করোনায় কষ্টে আছে। করোনার ভয়াল থাবা বাড়তে থাকলে তাঁদের জন্য আলাদা কোনো পরিকল্পনা কী আছে?

মাসুদ রানা : নিম্ন আয়ের মানুষ কষ্টে আছে সেটা আমরা বুঝি। কিন্তু জীবিকার চেয়ে জীবন বড়। সেজন্য সরকারের যে নির্দেশনা আমরা সেভাবে কাজ করে যাচ্ছি। যদি এরকম চলতে থাকে সেক্ষেত্রে অবশ্যই আমরা সরকারের বিভিন্ন প্রণোদনা পৌঁছে দিবো। ইতিমধ্যে আমরা প্রত্যেক ইউনিয়নে আড়াই টন করে চাল ও প্রায় আড়াই লাখ টাকা করে টাকা দিয়েছি। করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত ড্রাইভারদের আমরা আড়াই হাজার করে টাকা দিয়েছি। সরকার যখন যা দিবে আমরা তৃণমূলে দ্রুত তা পৌঁছে দিবো। এই সরকার মানবিক সরকার, অসহায় মানুষের কষ্ট বুঝে।

জাগো সিলেট : আপনি অনলাইনে কোরবানির পশু কিনতে উদ্বুদ্ধ করছেন! কেমন সাড়া পাচ্ছেন?

মাসুদ রানা : 'অনলাইন গবাদি পশুর হাট' নামে আমি একটা গ্রুপ খুলেছি। আমরা প্রচুর সাড়া পাচ্ছি। যদিও গ্রাম অঞ্চল, তবুও মানুষ অভ্যস্থ হচ্ছেন। এক সপ্তাহে হাজারের উপর মেম্বার হয়েছে গ্রুপে। কোরবানির আগে হয়তো আরও বাড়বে।

জাগো সিলেট :  সরকারের আশ্রয়ণ প্রকল্পে আওতাধীন গৃহহীনদের ঘর নিয়ে অনিয়ম ও দুর্নীতির নানা অভিযোগ উঠছে বিভিন্ন জেলায়। আপনার উপজেলায় এমন কোনো অভিযোগ পেয়েছেন?

মাসুদ রানা : বিষয়টি মানুষ তিলকে তাল বানিয়ে ফেলেছে৷ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এমন উদ্যোগের নজির পৃথিবীতে নেই। হয়তো কিছু জেলায় 'যৎ সামান্য' ঘরে সমস্যা দেখা দিয়েছে। কিন্তু বাকি ঘরগুলো মজবুত আছে। আমাদের উপজেলায় এমন অভিযোগ এখনো পাই নি। আমি সার্বক্ষণিক নজর রেখেছি৷ আমরা বানিয়াচংয়ে ১৭৫ টি ঘর অসহায়দের হাতে তুলে দিতে পেরেছি৷

জাগো সিলেট :  সম্প্রতি একটি বেসরকারি টেলিভিশনে সুটকি নদী নিয়ে 'অনুসন্ধানী প্রতিবেদন' প্রচারিত হয়েছে৷ ব্যক্তি মালিকানায় 'নদী দখলের' এমন নজির পৃথিবীতে নেই৷ আপনারা কি কোনো পদক্ষেপ নিবেন নদী দখলদারের বিরুদ্ধে?

মাসুদ রানা : যমুনা টেলিভিশনে সম্প্রচারিত অনুসন্ধানী প্রতিবেদনটি আমি দেখেছি। আমি সেখানে সাক্ষাৎকারও দিয়েছি। আমি সম্পুর্ন বিষয়টি জানি। ২০ একরের ঊর্ধ্বে জলমহালগুলো উপজেলা থেকে লিজ দেওয়া হয় না। এটি জেলা ও মন্ত্রণালয় থেকে করা হয়৷ যেহেতু এটা আমাদের সবার নজরে আসছে ও তারা সুটকি নদীকে 'বিল দেখিয়ে' নিজেদের পক্ষে রায় নিয়ে গেছে সেহেতু সরকারের পক্ষে আবার আপিল করা হবে। আপিলের জন্য মূল কাগজ লাগে। সেটা জেলা থেকে চাওয়া হয়েছে। খুব শীঘ্রই হয়তো আমরা দৃশ্যমান কিছু দেখতে পাবো।

জাগো সিলেট : বানিয়াচংয়ে পর্যটনের অপার সম্ভাবনা থাকলে এখানে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নেই। সাগরদিঘি, লক্ষ্মীবাওর, বিথঙ্গল আখড়াতে জেলা শহরের বাইরের পর্যটকরা আসলেও রাতে থাকার মতো পরিবেশ পান না! এগুলো নিয়ে আপনাদের কোনো পরিকল্পনা আছে?

মাসুদ রানা : আমরা পর্যটন বিকাশে কাজ করছি। সাগরদিঘি, লক্ষ্মীবাওর, বিথঙ্গল আখড়াসহ যেসব ঐতিহাসিক স্থাপনা ও জায়গা আছে সেগুলো বানিয়াচংয়ের সম্পদ! সাগরদিঘি নিয়ে একটা মামলা চলমান আছে। আমরা লিভ টু আপিলের জন্য সব কাগজপত্র পাঠিয়েছি অ্যাটর্নি জেনারেল বরাবর। আমি যোগদানের একমাসের মধ্যেই সেটা পাঠিয়েছি। আমাদের হবিগঞ্জের মন্ত্রী মহোদয়ও জানেন ব্যাপারটা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি আছে সাগরদিঘি নিয়ে৷ তিনি এখানে পর্যটন কেন্দ্র করার ঘোষণা দিয়েছিলেন, সেই ডকুমেন্টসও আমাদের কাছে আছে। কিন্তু চলমান মামলার কারণে আমরা এগুতে পারছি না। লক্ষ্মী বাওরের জন্য আমি ইতিমধ্যে ২৫ লাখ টাকার বরাদ্দ নিয়ে আসছি রেস্টহাউস নির্মাণের জন্য৷ ইতিমধ্যে টেন্ডারও হয়ে গেছে। বর্ষার কারণে কাজ শুরু হচ্ছে না। আমরা শীঘ্রই কাজ শুরু করবো। আমাদের সরকারি নির্ধারিত স্থানে কাজ শুরু হবে। বিথঙ্গল আখড়ায় প্রচুর মানুষ আসে প্রতিবছর। হিন্দু-মুসলমান সবাই সেখানে ঘুরতে যান। কিন্তু অতিথিদের জন্য বসার বা খাওয়ার তেমন সুযোগ সুবিধা নাই। সেজন্য আমরা সেখানে সরকারি অর্থায়নে অতিথিদের জন্য রেস্টহাউজ তৈরি করছি। কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। এছাড়া আমাদের এলাকায় যেসব ঐতিহাসিক বা স্মৃতিবিজড়িত স্থান রয়েছে সেগুলোর রক্ষণাবেক্ষণের জন্যও কাজ করছি। বানিয়াচংয়ে অনেক পুরনো আমলের মসজিদ আছে। সেগুলোও আমাদের সম্পদ। আমাদের বানিয়াচং সদরে থাকার তেমন সুবিধা না থাকায় আমাদের সরকারি ডাকবাংলোটিতে দ্বিতল ভবন নির্মাণ করার জন্য জেলা পরিষদের সাথে কথা বলেছি। তাঁরা এ ব্যাপারে ইতিবাচক।

জাগো সিলেট : বানিয়াচং নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?

মাসুদ রানা : বানিয়াচং নিয়ে আমার সার্বিক মূল্যায়ন অবশ্যই ভালো, পজিটিভ। করোনা ভাইরাস না থাকলে হয়তো আরও বেশি কাজ করতে পারতাম। করোনার কারণে কাজের পরিধি সীমিত হয়ে গেছে। তারপরও চেষ্টা করছি শতভাগ সততা, দক্ষতা কাজে লাগিয়ে মানুষের জন্য কাজ করে যাওয়ার। মূল্যায়ন বানিয়াচংবাসী করবে।

জাগো সিলেট : আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

মাসুদ রানা : জাগো সিলেটকেও ধন্যবাদ। একই সঙে পাঠক, শুভানুধ্যায়ীসহ সবাইকে শুভেচ্ছা।