স্বামীহারা ঝর্নার জীবন জয়ের গল্প

স্বামীহারা ঝর্নার জীবন জয়ের গল্প

ছোট্ট মুদি দোকান। সামান্য নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য আছে তাতে। এতে প্রতিদিন যা বিক্রি হয় তাতে সংসার চালানোই কষ্টসাধ্য ব্যাপার। এজন্য রাতে পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে কাজ করেন একটি বেসরকারি হাসপাতালে। হাড়ভাঙা এ পরিশ্রম শুধুমাত্র ছেলে-মেয়েকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্য!

এটি কোন পরিশ্রমী পুরুষের গল্প নয়, স্বামীহারা একজন নারীর বেদনার গল্প। যিনি কাকডাকা ভোর থেকে গভীর রাতঅব্দি জীবনের সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন।

বলছিলাম ঝর্না রানী দাশের (৫০) কথা। জীবনের বাঁকে বাঁকে হোঁচট খেয়েও হতাশ না হওয়া এই অদম্য নারী ছোট্ট মুদি দোকানের আয়ে ছেলেকে চিকিৎসক আর মেয়েকে হিসেবে বিজ্ঞান বিভাগে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করছেন।

ঝর্না রানী সিলেটের পাঠানটুলা এলাকার মৃত পিযুষ কান্তি দাশের স্ত্রী। নগরের রাগিব রাবেয়া মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল এলাকায় ছোট্ট মুদি দোকান রয়েছে তার। পাশাপাশি  রাগিব রাবেয়া হাসপাতালে রাতে পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে কাজ করেন।

ঝর্না জানান, সুনামগঞ্জের দিরাইয়ে তাঁর স্বামীর বাড়ি। দুই ছেলে আর এক মেয়ে নিয়ে তার সংসার। বছর দুয়েক আগে স্বামী মারা যান। তখন অসহায় হয়ে পড়েন তিনি। শুরু করেন ছোট ব্যবসা। এরিমধ্যে ছেলে এসএসসি পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করে। ধারদেনা করে ছেলে প্রিতম দাশ অন্তরকে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি করান। পরে হবিগঞ্জ শেখ হাসিনা মেডিক্যাল কলেজে টিসি নিয়ে প্রতিষ্ঠান পরিবর্তন করে। মেয়ে প্রিয়াঙ্কা রানীকে সিলেটের মদনমোহন কলেজে হিসাব বিজ্ঞান বিভাগে (অনার্স) ভর্তি করান। আর ছোট ছেলে রাজ নগরের সিটি মডেল স্কুলে তৃতীয়  শ্রেণীতে পড়াশোনা করছে।

সম্প্রতি ঝর্নার মুদি দোকানে গিয়ে দেখা যায়, ছোট দোকানে পান-সিগারেট, বিস্কিট আর শিশুদের খাবারসহ সামান্য পণ্য রয়েছে। দেখে বুঝার উপায় নেই তার সীমাহীন কষ্টের যন্ত্রণা। ক্রেতাদের ভিড় রয়েছে কিছুটা। যেন আপন গতিতে চলছে তার জীবনের সীমারেখা!

আলাপকালে ঝর্না বলেন, স্বামী জীবিত থাকা কালেও কষ্ট করে সংসার  চলতো। আমার স্বামীর ইচ্ছে তার বড়ছেলে লেখাপড়া করে চিকিৎসক হবে। গরীব মানুষদের বিনামূল্যে সেবা দিবে। এখন তিনি বেঁচে নেই। উনার ইচ্ছাকে আমি মরতে দিবো না। জীবনের শেষ রক্ত বিন্দু দিয়ে হলেও আমি ছেলেকে চিকিৎসক বানাবো। মেয়েকে সরকারী চাকরীতে যোগ দেওয়াবো।

ছেলে প্রিতম দাশ অন্তর বলেন, আমার মায়ের কষ্ট দেখে অনেক সময় খারাপ লাগে। আমার বাবার স্বপ্ন ছিলো আমি ডাক্তার হবো। আমি সেই লক্ষে আমার পড়াশোনা চালিয়ে নিচ্ছি। 
পরিশ্রমী এই নারী বলেন, দোকানে  যা আয় হয় তাতে বাসাভাড়া আর সংসারের খরচ চালাতে হিমসিম খেতে হয়। এজন্য রাতে হাসপাতালে কাজ করি। কারো কাছে সাহায্য চাই না। সৎ পথে উপার্যন করে ছেলে- মেয়েকে মানুষের মতো মানুষ বানাতে চাই।

মুদি দোকান দিয়ে ছেলে মেয়েকে এতো দুর পর্যন্ত লেখাপড়া করাচ্ছি এতে কিছু দুষ্ট লোক প্রায় সময়ই খারাপ কথা বলে। সমালোচনা করে। প্রথমে যখন ২০২০ সালে দোকান শুরু করি তখন অনেকই বিরোধীতা করেছে। এই বিষয়গুলো মাঝেমধ্যে কিছুটা কষ্ট দেয়। কিন্তু এতে আমি থেমে যাবো না। আমি আমার গন্তব্যে যাবো। সমাজকে দেখাবো একজন নারী হয়েও আমি হাল ছাড়িনি। বলেন- ঝর্না রানী।

ব্যক্তি কিংবা সরকারী কোন সহযোগীতা পাননি জানিয়ে এই নারী বলেন, স্বামী মারা যাওয়ার পর কেউ আমার পাশে দাড়ায় নি। অনেকের কাছে গিয়েছি। কেউ একটুখানি সাহয্য করেনি। কিস্তির মাধ্যমে টাকা নিয়ে এই দোকান করেছি।

এ ব্যাপারে সিলেট জেলা সমাজ সেবা অফিসের উপপরিচালক নিবাস রঞ্জন দাশ বলেন, ‘ এ সংগ্রামী নারীর গল্পটা আসলেই কষ্টদায়ক। তবে এটা সমাজের জন্য খুবই ইতিবাচক। অন্যরা এতে প্রেরণা পাবে। আমরা তার খোঁজ-খবর নিবো। জেলা সমাজ সেবা অফিসের পক্ষ থেকে তাকে এককালীন আর্থিক একটা সহযোগিতা করার চেষ্টা করবো। এছাড়াও তার গ্রামের বাড়ি দিরাই থেকে বিধাব ভাতা কিভাবে দেওয়া যায় সেই ব্যাপারে ব্যবস্থা করবো।’