ডিজিটাল সিটিতে বন্যায় ভয়াবহ পরিণতির কারণ কী?
সিলেট শহরকে বলা হয় দেশের প্রথম ডিজিটাল সিটি। নানা সময় সরকারের একাধিক মন্ত্রীর বক্তব্যেও তা উঠে এসেছে। দেশের প্রথম তারবিহীন শহর হিসেবেও পরিচিতি পেয়েছে এই শহর। আর আইটি ক্যামেরা ও ফ্রি পাবলিক ওয়াইফাই সেবা চালুর মধ্য দিয়ে ২০২০ সালের মার্চে দেশের প্রথম ডিজিটাল সিটির উপাধি পায় পূণ্যভূমি খ্যাত এই শহর। অথচ এই 'ডিজিটাল সিটি' এখন যেন পানির শহর! উজানের ঢল আর ঢানা বৃষ্টির পানিতে বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে নগরজুড়ে। রাস্তাঘাট, বাসাবাড়ি, সরকারি-বেসরকারী প্রতিষ্ঠান, এমনকি জরুরী সেবা দানকারী বিদ্যুৎ, ফায়ার সার্ভিস, বিভাগীয় কমিশনার, পুলিশ কমিশনারের কার্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানও প্লাবিত হয়েছে।
গত ১১ মে থেকে ভারিবর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে সিলেটের বিভিন্ন উপজেলা পানিবন্দি হবার পর ১৬ মে থেকে সুরমার পানি উপচে নগরেও পানি ঢুকতে শুরু করেছে। সৃষ্টি হয়ছে চরম জলাবদ্ধতা। পানি ডুকে পড়ে বাসাবাড়িতে। দ্রুতই তা বন্যা আকার ধারণ করেছে। আশ্রয় কেন্দ্রে ছুটছেন মানুষ। ইতিমধ্যেই খাবারের অভাব, বিশুদ্ধ পানির হাহাকার, বিদ্যুতহীনতা, চরম দুর্ভোগ আর সীমাহীন ভোগান্তিতে পড়েছেন পানিবন্দি মানুষ। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে শুকনো খাবার ও নগদ অর্থ বিতরণ শুরু হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠছে দেশের প্রথম ডিজিটাল সিটিতে জলাবদ্ধতা ছাড়িয়ে বন্যা আকার ধারণ করা কারণ কী?
এ নিয়ে নগর বিশেষজ্ঞ, জনপ্রতিনিধি, রাজনীতিবিদ ও সচেতন মহলের সঙ্গে কথা বলেছেন এই প্রতিবেদক।
তারা বলছেন, প্রায় ২৪৯ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরের সুরমা দেশের দীর্ঘতম নদী। নগরীর সুরমা নদী শহরের মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে। এই শহরের গুরুত্বপূর্ণ এই নদী দখল ও বর্জ্যের চাপে বিপর্যস্ত। দখল-দূষণ আর সুরমার দুই পাড় দখল করে স্থাপনা গড়েছে শতাধিক দখলদার। সেই সঙ্গে নগরীর অধিকাংশ বস্তির শৌচাগারের পাইপ সরাসরি নামানো হয়েছে নদীতে। এতে ক্রমশ ভরাট হচ্ছে সুরমা। মূলত এসব কারণেই বর্ষা মৌসুমে বন্যা দেখা দিচ্ছে এই অঞ্চলে। এছাড়া এই শহরের অনেক দিঘী ও পুকুর ছিলো সেগুলো এখন আর নেই।
সুরমা নদী খনন করলে শহরের ড্রেনেও প্রয়োজন নেই জানিয়ে লেখক ও সাংবাদিক উজ্জ্বল মেহেদী বলেন, সুরমা নদী সিলেট নগরের পাশ দিয়ে যে অংশগুলো বয়ে গেছে সেখানে ৮-১০ টি ময়লা আর্বজনার স্থর এসে পড়েছে। এতে নদী ভরাট হয়ে আসছে। সর্বশেষ ১৯৭৩ সালে সামন্য খনন করা হয়েছে তারপর আর এই নদী খনন করা হয়নি। অন্যদিকে নগরের শেখঘাট এলাকায় অবস্থিত কাজিরবাজার বিজ্র নির্মান করায়ও নদীতে নাব্যতা সৃষ্টি হয়েছে। কারণ এই বিজ্র এলাকা সুরমার সবছেয়ে গহীন ছিলো। এখন তা ভরাট হয়ে গেছে।
সুরমা নদী সিলেটের জন্য আর্শিবাদ উল্লেখ করে তিনি বলেন, একমাত্র সরমা নদীকে যদি আগের রুপে ফেরানো যায় তাহলে আমাদের শহরে আর এই সমস্যা থাকবে না।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে সিভিল অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক জহির বিন আলম বলেন, সুরমা নদী খনন করা হয়নি অনেক দিন থেকে। এবারের সিলেটের জলাবদ্ধতা ছড়ার কারনে না। উজানের ঢল আর কুশিয়ারার পানি সুরমায় এসেছে। এ পানি সুরমা ধরে রাখতে পারেনি। এটাকে আমরা ব্যাকওয়াটার এপেক্ট বলি। নদীর পানি শহরে ডুকে গেসে। এখন আবশ্যক হয়ে পড়েছে দ্রুত নদী খনন করা। পানি উন্নয়ন বোর্ডের উচিৎ তড়িৎ গতিতে তারা পদক্ষেপ নেওয়া।
এই নগর বিশেষজ্ঞের পরামর্শ ; সুরমা খননের কাজ কোন কোম্পানিকে দেওয়া হোক। এরকম অনেক কোম্পানি আছে যারা বিজ্ঞান সম্মত ভাবে নদী থেকে মাটি তুলে। এরকম প্রতিষ্ঠানকে লিজ দিলে একদিকে সরকারের যেমন আয় হবে তেমনিভাবে সুরমাও তার ভরসাম্য রক্ষা পাবে।
সুরমা নদীর নাব্যতার পাশাপাশি সিলেট সিটি করপোরেশনকেও দায়ি করছেন তরুণ রাজনীতিবিদ ও সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ডা. আরমান আহমেদ শিপলু।
তিনি মনে করেন, সুরমা নদীর নাব্যতা একটা দীর্ঘ সমস্যা। নাব্যতা ফেরাতে সরকার কাজ করছে। তবে এখানে সিলেট সিটি করপোরেশনের দায় এড়ানোর কোন সুযোগ নেই। দীর্ঘদিন থেকে চলমান উন্নয়ন কাজে ধীরগতি, এক সড়ক খোড়াখুড়ি করে কাজ সম্পন্ন না করেই অন্য সড়কে কাজ শুরু করা। ড্রেনের সংস্কার কাজ মানসম্মত না হওয়া এই পরিস্থিতির অন্যতম কারণ।
শিপলু বলেন, অবশ্যই তড়িৎগতিতে সুরমা নদী খনন করতে হবে। পাশাপাশি এই সিটি দেখবালের দায়িত্ব জনগণ যাদের হাতে তুলে দিয়েছে তাদের মমতা-দরদ দিয়ে কাজ করতে হবে। পরিকল্পনা করে কাজ করলে আমাদের এই রকম ভয়াবহ পরিস্থিতির শিকার হতে হবে না।
প্রায় ১০০ বছরের কাছাকাছি সময় সুরমা নদী খনন করা হয়না; এজন্য নগরীর এই করুণ অবস্থা বলে মনে করছেন সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী।
তিনি বলেন, আমাদের শহর নদীঘেষা। শহরের মধ্যখান দিয়ে বয়ে চলা সুরমা নদী খননের কোন উদ্যোগ নেই। বারবার আমরা বলে আসছি এ কথা। আমি মনে করি সুরমা নদীর নাব্যতা ফেরাতে পারলেই আমাদের আর এই সমস্যা থাকবে না। সিলেট সিটি করপোরেশন সবসময় জনগণের জন্য কাজ করে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও সিলেট-১ আসনের সংসদ সদস্য ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, সিলেটের প্রধান দুই নদী সুরমা ও কুশিয়ারার তলদেশ ভরাট হয়ে গেছে। এই দুই নদী খনন করতে হবে।
বুধবার বন্যা দূর্গত সিলেটে পরিদর্শনকালে গণমাধ্যমে মন্ত্রী বলেন, সিলেটে এই মৌসুমে সব সময়ই ঢল নামে। আমরা ছেলেবেলাতেও এমনটি দেখেছি। কিন্তু পানি আটকে থাকত না। চলে যেত। কারণ আমাদের আগে অনেক পুকুর ও দিঘি ছিল। প্রত্যেক বাড়ির সামনে পুকুর ছিল। আর সিলেটকে বলা হতো দিঘির শহর। কিন্তু এখন আমরা নগরীর ভেতরের সব পুকুর-দিঘি ভরাট করে বড় বড় বিল্ডিং করেছি। হাওরগুলো ভরাট করে ফেলেছি। এ ছাড়া প্রধান নদীগুলোর তলদেশ ভরাট হয়ে গেছে। খালি মাঠগুলো ভরাট হয়ে গেছে। এ কারণে পানি নামতে পারছে না।