মুক্ত চিন্তার নিরংহকারী একজন আব্দুল খালিক মায়ন

মুক্ত চিন্তার নিরংহকারী একজন আব্দুল খালিক মায়ন

মুক্তাদীর আহমদ মুক্তা ।। আব্দুল খালিক মায়ন। আমাদের প্রিয় মায়ন ভাই। ছিলেন একজন পরিচ্ছন্ন রাজনীতিবিদ। মুক্ত চিন্তা চেতনার একজন নিরংহকারী মানুষ। মায়ন ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয় কলেজ জীবনের শুরুতেই। আওয়ামী লীগের একজন নেতার সঙ্গে  ছাত্রলীগের একজন সাধারণ কর্মীর যেটুকু দূরত্ব থাকে, তিনি তাঁর স্বভাবসুলভ সারল্যে সেই দূরত্বটুকু দূর করে দিলেন পরিচয়ের কিছু দিনের মধ্যেই। 

১৯৯৪ সালে সিলেট বিভাগ বাস্তবায়ন আন্দোলনে তিনি তখন সক্রিয় সংগঠক। আমাদেরকে ছাত্র সংগঠন গড়ার পরামর্শ দিলেন। এক পর্যায়ে বিভাগ বাস্তবায়ন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন হয়। জেলা পর্যায়ে একটি স্টিয়ারিং কমিটির মাধ্যমে ছাত্র সংগঠন পরিচালিত হতো। লতিফ সেন্টারে অফিস নেওয়া হয়। সিলেট সরকারি কলেজ, বিভাগ বাস্তবায়ন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য হিসেবে নিজেও সক্রিয় সকল কর্মসূচিতে। এই সুবাদে মায়ন ভাই'র বাসায় যাওয়া আসা বাড়তে থাকে। পরিচয় ঘনিষ্টতায় রূপ নেয়। তারপর থেকে আন্দোলন সংগ্রামের নিরন্তর পথচলায় হয়ে ওঠেন তিনি এক নির্ভরযোগ্য প্রিয় নেতা।

কত ঘটনা। কত স্মৃতি। একজন জনপ্রিয় ছাত্রনেতা থেকে সফল জননেতা মায়ন ভাই রাজনীতির আমুদে মানুষ। তবু এতো সারল্য ছিল তাঁর মাঝে জানা ছিল না। ২০০৯ সালে তিনি যখন বিয়ানীবাজার উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন আমি তখন জগন্নাথপুর উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হই। উপজেলা পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালনের সুবাধে বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ে প্রায়ই মায়ন ভাইর সঙ্গে দেখা হতো। পরিষদের কার্যক্রম নিয়ে বিভিন্ন বিষয়ে আলাপচারিতা থেকে গভীর আন্তরিকতা। মাঝে মধ্যে ফোন করতেন

 "ওবা, কিতা করো,ই বিষয়টা কেমনে কিতা কও চাইন। তুমি তো ইতা ভালা বুঝো " যখন বলতাম, লিডার ইতা কিতা কইন। যা হিকরাম তো আফনারে দেইখ্যা, দেইখ্যা। খুব খুশী হতেন। একবার ঢাকায় এক সপ্তাহের জন্য আমাদের কর্মশালা। তিনি ফোন করলেন।" কিতাবা চেয়ারম্যান সাব, ঢাকাত যাইতানানি "। বললাম লিডার, যাইমু। বললেন " যাইমু কিতা, একলগে যাইমু, আমার গাড়িতে যাইবায়, আমার লগে,আপত্তি আছে নি "। এমনই ছিলেন মায়ন ভাই।

ঢাকায় একসঙ্গে যাই। একরুমে এক সপ্তাহ থাকি। তখনই মূলত একজন সহজিয়া মানুষের পরিচয় পাই। এতো সদালাপী ও দিলখোলা মানুষ মায়ন ভাই তা গভীরভাবে জানার সুযোগ হয়। তখনই দেখি। তিনি প্রচুর ঔষধ সেবন করেন। শরীর অসুস্থ। বাইরে থেকে বুঝা যায় না। এতো প্রানবন্ত মানুষ অসুখ পাত্তা পায় না। ঢাকায় গিয়ে সুনামগঞ্জের জাকেরীন ভাই, জামালগঞ্জের ইউসুফ ভাই, দক্ষিণ সুনামগঞ্জের ফারুক ভাই ও ছাতকের মিজান ভাইয়ের সঙ্গে দেখা।
 
ইউসুফ ভাই আর মায়ন ভাই কদিনেই গভীর অন্তরঙ্গ হয়ে উঠেন। দুজনেই বীর মুক্তিযোদ্ধা। দুজনেই সংগীতানুরাগী। আজ দুজনেই পরপারে। আড্ডা, গান আর প্রশিক্ষণ কর্মশালায় খালিক ভাই ছিলেন সবচেয়ে প্রানবন্ত। আমরা দলবেঁধে প্রয়াত জাতীয় নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলাম। একজন সংস্কৃতিমান, শিক্ষিত, মার্জিত রাজনৈতিক নেতা ছিলেন  তিনি। কত কথা মনে পড়ছে। এক সপ্তাহের ট্যুর শেষে  মায়ন ভাইয়ের সঙ্গেই তার গাড়িতে ফিরেছি। নতুন এক মায়ন ভাই কে আবিস্কার করেছি সেই সময়। অনুজদের প্রতি এতো আন্তরিকতা খুব কম রাজনৈতিক নেতার মধ্যেই দেখেছি। প্রকৃতঅর্থে তিনি ছিলেন সহৃদয়বান মানুষ। মায়ার মানুষ। 

আব্দুল খালিক মায়ন ১৯৫১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি সিলেটের বিয়ানীবাজার থানার দুবাগ ইউনিয়নের মেওয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা ইয়াওর আলী ও মাতা তইয়বুন্নেছার তিনি ছিলেন ষষ্ঠ সন্তান। তিনি নিজ এলাকার ‘শরৎচন্দ্র পাঠশালা ‘থেকে প্রাথমিক ও ‘দুবাগ উচ্চ বিদ্যালয়’ থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৬৭ সালে তিনি সিলেট  এমসি কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণীতে ভর্তি হন। কলেজে ভর্তি হয়েই তিনি ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। অনর্গল ও সাবলীল ভাষায় বক্তৃতা করতে পারতেন আব্দুল খালিক মায়ন। এজন্য বন্ধুবান্ধব,  সহপাঠী ও সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের কাছে ছিলেন জনপ্রিয়।  তিনি এমসি কলেজ ছাত্র সংসদের সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। ছাত্র ইউনিয়নের অবিভক্ত  সিলেট জেলার সাধারণ সম্পাদকেরও দায়িত্ব পালন করেছেন।

১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে তিনি ৪ নম্বরে সেক্টরে, মেজর জেনারেল সি.আর. দত্তের অধীনে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭২ সালে বি.এ পরীক্ষায় উত্তীর্ন হন। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগে যোগদান করেন। ১৯৭৭ সালে সিলেট আওয়ামী যুবলীগের আহবায়ক নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে কেন্দ্রীয় যুবলীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৮১ সালে সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে দীর্ঘদিন সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।

একবার দিরাইয়ের ধলে শাহ আব্দুল করিম উৎসব মাঠে দেখি তিনি উপস্থিত। আয়োজনের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকায় খালিক ভাইকে আমন্ত্রন জানাইনি এ জন্য তাঁকে দেখেই খুবই লজ্জা পাচ্ছি। তিনি জড়িয়ে ধরে বললেন, " কিতা বা আমারে তোমারা ইতাত কওনা। হুন্নিয়া আইলাম"।

২০১০ সালে আওয়ামী লীগের জাতীয় কাউন্সিল শেষে নেত্রীকে শুভেচ্ছা জানাতে নেত্রীর তৎকালীন বাসভবন  'সুগন্ধায়' যান প্রয়াত ইফতেখার হোসেন শামীম ভাই আর আব্দুল খালিক মায়ন ভাই। ঘটনাক্রমে আমি সেখানে উপস্থিত। তিনি পূর্ণাঙ্গ কার্যকরি কমিটিতে একজনকে অন্তর্ভূক্তির জন্য দাবি জানিয়েছিলেন। সেদিন পেয়েছি  প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর আন্তরিক সম্পর্কের পরিচয়। কিন্তু তিনি কোনোদিন ক্ষমতার প্রভাব দেখাননি। সারাজীবন জনতার রাজনীতি করে গেছেন নিস্কলুষভাবে। সৎ, নিষ্ঠাবান ও আদর্শিক রাজনীতিবিদ হিসেবে তিনি ছিলেন সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য। এমন জনবান্ধব জননেতার আজ বড় অভাব।

কর্মীবান্ধব এই জননেতা ২০১১ সালের ২৯ জানুয়ারি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মাত্র ৬১ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। আজ তাঁর ১১তম মৃত্যুবার্ষিকী। জনহিতে নিবেদিত সাদামনের মানুষ প্রিয় মায়ন ভাইয়ের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা। পরম করুণাময় যেন তাঁকে  জান্নাতুল ফেরদাউস নসিব করেন। চির প্রশান্তিতে থাকুন প্রিয় নেতা।