জুড়িতে সাফারি পার্কের জন্য কেনা হবে ২০৩ কোটি টাকার বন্যপ্রাণি

জুড়িতে সাফারি পার্কের জন্য কেনা হবে ২০৩ কোটি টাকার বন্যপ্রাণি

মৌলভীবাজারের জুড়ীতে আরেকটি বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক নির্মাণ প্রকল্পের দিকে এগোচ্ছে সরকার। এই সাফারি পার্কটি নির্মাণ করা হচ্ছে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিনের নির্বাচনী এলাকায়। ৮৪৬ কোটি ২৫ লাখ টাকা সম্ভাব্য ব্যয় ধরে ওই পার্কের মহাপরিকল্পনা চূড়ান্ত করেছে বন অধিদপ্তর। জুড়ীতে লাঠিটিলা সংরক্ষিত বনের এলাকায় ওই পার্কে মূলত বিদেশি প্রাণী আনা হবে।

মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী, সাফারি পার্কটিতে বন্য প্রাণী বাবদ ২০৩ কোটি ৪০ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এর মধ্যে শুধু বন্য প্রাণী কেনা বাবদ রাখা হয়েছে ১৮২ কোটি টাকা। বাকি টাকা রাখা হয়েছে আমদানি করা প্রাণীগুলোর রক্ষণাবেক্ষণসহ অন্যান্য খাতে ব্যয়ের জন্য। তবে বন বিভাগ ওই বরাদ্দ কিছুটা কমিয়ে বন্য প্রাণী কেনা বাবদ বরাদ্দ ১৪৬ কোটি রাখার প্রস্তাব করেছে।

পরিকল্পনায় সিংহ, বাঘ, জিরাফ, জেব্রাসহ ১৩৭ ধরনের বন্য প্রাণী ক্রয়ের কথা বলা হয়েছে। বন্য প্রাণীর বড় অংশ আমদানির কথা বলা হয়েছে আফ্রিকা থেকে। চলতি বছর থেকে শুরু হয়ে ২০২৬ সালের মধ্যে এর নির্মাণকাজ শেষ করার কথা বলা হয়েছে। আর সাফারি পার্কটির বাজেটের মধ্যে এক কোটি টাকা রাখা হয়েছে বিদেশে প্রশিক্ষণ বাবদ।

পরিবেশবাদীদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, লাঠিটিলা সংরক্ষিত বন দেশের অন্যতম জীববৈচিত্র্য এবং বন্য প্রাণীপূর্ণ এলাকা। বন উজাড় হওয়া ও চোরা শিকারিদের তৎপরতায় সেখানকার প্রাণীরা এমনিতেই বিপদে আছে। তাদের সংরক্ষণের জন্য কোনো আলাদা উদ্যোগ বা প্রকল্প না নিয়ে সেখানে সাফারি পার্ক নির্মাণের উদ্যোগে প্রাণীরা আরও বিপদে পড়তে পারে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সভাপতি সুলতানা কামাল বলেন, দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সংরক্ষিত বন এলাকায় এ ধরনের সাফারি পার্ক নির্মাণ কোনোভাবেই উচিত না। এ ধরনের প্রকল্পের কারণে লাঠিটিলা সংরক্ষিত বনের জীববৈচিত্র্য যতটুকু টিকে আছে, তা আরও ধ্বংসের দিকে যাবে। সরকারের উচিত সাফারি পার্ক নির্মাণ করা থেকে সরে আসা। সুলতানা কামাল বলেন, পরিবেশ রক্ষার সঙ্গে যুক্ত থাকা অনেকে এ ধরনের প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছেন। এটা অনৈতিক ও স্বার্থের সংঘাত তৈরি হচ্ছে।

লাঠিটিলা সংরক্ষিত বনের মোট আয়তন ৫ হাজার ৬১৫ একর। এর মধ্যে ১৭৫ একর জায়গায় সাফারি পার্কের মূল অবকাঠামো নির্মাণ করা হবে। তবে বনের বাকি অংশ সাফারি পার্কের আওতায় চলে আসবে। সাফারি পার্ক নির্মাণ বিষয়ক সমীক্ষা ও মহাপরিকল্পনা বন বিভাগ গ্রহণ করেছে। এখন তারা তা মন্ত্রণালয়ে প্রকল্প হিসেবে জমা দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে

।বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক, মৌলভীবাজার প্রকল্পের পরিচালক রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, ‘বনের একটি অংশ দখল করে পুরোপুরি গ্রাম বানানো হয়েছে। মূলত এই গ্রাম দুটির মধ্যে আমরা সাফারি পার্কটি নির্মাণ করছি। পার্কটি রাস্তার পাশের জায়গায় নির্মাণ করা হবে। ফলে বনের তেমন ক্ষতি হবে না। উল্টো এই পার্কের মাধ্যমে বনভূমিটি আরও সমৃদ্ধ হবে।

’মহাপরিকল্পনায় বলা হয়েছে, প্রস্তাবিত সাফারি পার্কের ২০ কিলোমিটারের মধ্যে মাধবকুণ্ড ইকোপার্ক রয়েছে। এ ছাড়া লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান এই পার্কের ৫০ কিলোমিটার এবং হাকালুকি হাওর ২৫ কিলোমিটারের মধ্যে অবস্থিত। ওই দুই পার্ক ও উদ্যানে বছরে ১ লাখ ২০ হাজার এবং ২ লাখ ভ্রমণকারী যায়। বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক হলে বছরে সেখানে ১৫ থেকে ২০ লাখ দর্শনার্থী যাবে। সেখান থেকে বছরে ২৫ থেকে ৩০ কোটি টাকা আয় হবে বলে মনে করা হচ্ছে। আর পার্কটির মাধ্যমে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ৫০০ মানুষের কর্মসংস্থান হবে।

এর আগে ১৯৯৯ সালে কক্সবাজারের ডুলাহাজারায় বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক নামে একটি এবং গাজীপুরে আরেকটি বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক নির্মিত হয় ২০১৩ সালে। ওই দুটি সাফারি পার্ক নির্মাণের প্রাথমিক দায়িত্বে ছিলেন বন বিভাগের সাবেক বন্য প্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ অঞ্চলের বন সংরক্ষক তপন কুমার দে। এই সাফারি পার্কের প্রাথমিক সমীক্ষা করার ক্ষেত্রেও সাবেক এই বন কর্মকর্তা যুক্ত রয়েছেন।

ওই দুই সাফারি পার্কের মধ্যে গাজীপুরে বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কে সম্প্রতি ১১টি জেব্রা, ১টি বাঘ ও ১টি সিংহী মারা গেছে। এ নিয়ে সারা দেশে আলোচনা ও সমালোচনা সৃষ্টি হয়েছে। কী কারণে প্রাণীগুলো মারা গেল, এখনো তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়নি।তপন কুমার দে বলেন, ‘আমরা নতুন সাফারি পার্কে প্রাণীদের জন্য খাদ্য হিসেবে ঘাস ও অন্যান্য ফসল রোপণ করার পরিকল্পনা করেছি। আগের সাফারি পার্কগুলোতেও ছিল। কিন্তু তা কাজে লাগানো হচ্ছে না।’

নিজ এলাকায় সাফারি পার্ক নির্মাণের বিষয়ে মন্ত্রী শাহাব উদ্দিনের কোনো বক্তব্য নেয়া সনভব হয়নি।এই পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাইলে বন্য প্রাণী বিশেষজ্ঞ রেজা খান বলেন, ‘দেশের সংরক্ষিত বনে সাফারি পার্ক কেন নির্মাণ করার দরকার হচ্ছে আমি তা বুঝতে পারছি না। বনের যে বন্য প্রাণীগুলো আছে, সেগুলো ঠিকমতো সংরক্ষণে বন বিভাগের মনোযোগ দেওয়া উচিত। এই সাফারি পার্ক নির্মাণ করলে লাঠিটিলা বন ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাবে।’