মৌসুমের আগেই ডেঙ্গুর চোখরাঙানি

মৌসুমের আগেই ডেঙ্গুর চোখরাঙানি

প্রতি বছর জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি হয়ে থাকে। এই চার মাসকে বলা হয়ে থাকে ‘ ডেঙ্গুর পিক মৌসুম’। তবে বাংলাদেশে সারা বছরই এডিস মশার উপস্থিতি থাকে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, এবার মৌসুমের অনেক আগেই রাজধানীতে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়তে শুরু করেছে। পিক মৌসুমে পরিস্থিতি ভয়ানক রূপ নিতে পারে। তাই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি নগরবাসীকেও সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। গত দুই বছর ধরে করোনাভাইরাসের ভিড়ে ডেঙ্গু রোগী ও তাদের চিকিৎসার বিষয়টি তেমন আলোচনায় আসতে পারেনি। কিন্তু থেমে থাকেনি ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশার প্রজনন বিস্তার। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজধানীতে সারা বছর ডেঙ্গু রোগী পাওয়া যায়। এখন আর ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার নির্ধারিত মৌসুম নেই। তবে গত দুই মাস ধরে গত বছরের তুলনায় প্রতিদিন আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে থাকায় চিন্তামুক্ত থাকতে পারছেন না নগরবাসী।

বিভিন্ন বছরে রাজধানীতে ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা মাসভিত্তিক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি হয়ে থাকে। ২০২২ সালের এপ্রিলে ৩৩ জন ও মে মাসে ৫৭ জন (১৯ মে পর্যন্ত) ডেঙ্গু রোগী পাওয়া গেছে। ২০২১ সালের জানুয়ারিতে ৩২ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৯ জন, মার্চে ১৩ জন, এপ্রিলে ৩ জন, মে মাসে ৪৩ জন, জুনে ২৭২ জন, জুলাইয়ে ২ হাজার ২৮৬ জন, আগস্টে ৭ হাজার ৬৯৮ জন, সেপ্টেম্বরে ৭ হাজার ৮৪১ জন, অক্টোবরে ৫ হাজার ৪৫৮ জন, নভেম্বরে ৩ হাজার ৫৬৭ জন ও ডিসেম্বরে ১ হাজার ২০৭ জন হাসপাতালে ভর্তি হন। এভাবে ওই বছর মারা যাওয়া ১০৫ জনের মধ্যে জুলাইয়ে ১২ জন, আগস্টে ৩৪ জন, সেপ্টেম্বরে ২৩ জন, অক্টোবরে ২২ জন, নভেম্বরে সাতজন ও ডিসেম্বরে সাতজনের মৃত্যু হয়।

২০১৯ সালের এক ভয়াবহ আতঙ্কের নাম ডেঙ্গু। ওই বছর জানুয়ারিতে ৩৮ জন, ফেব্রুয়রিতে ১৮ জন, মার্চে ১৭ জন, এপ্রিলে ৫৩ জন, মে মাসে ১৯৩ জন, জুনে ১৮৮৪ জন, জুলাইয়ে ১৬,২৫৩ জন, আগস্টে ৫২,৬৩৬ জন, সেপ্টেম্বরে ১৬,৮৫৬ জন, অক্টোবরে ৮১৪৩ জন, নভেম্বরে ৪০১১ জন ও ডিসেম্বরে ৯৪ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত করা হয়। ওই বছর সরকারি পরিসংখ্যানেই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা যায় ১২৯ জন।

এভাবে ২০১৫ সালের মার্চে দুজন, এপ্রিলে দুজন, মে মাসে একজন, জুনে ১৫ জন, জুলাইয়ে ১৫৬ জন, আগস্টে ৭২৭ জন, সেপ্টেম্বরে ৯৬৫ জন, অক্টোবরে ৮৮০ জন, নবেম্বরে ২৬০ জন ও ডিসেম্বরে ৯০ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়। রাজধানীতে ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে ৬ জন, ফেব্রুয়াারিতে ৭ জন, মার্চে তিনজন, এপ্রিলে ৩ জন, মে মাসে ১২ জন, জুনে ৫০ জন, জুলাইয়ে ১৭২ জন, আগস্টে ৩৩৯ জন, সেপ্টেম্বরে ৩৮৫ জন এবং অক্টোবরে আক্রান্ত হয় ৫০১ জন।

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে মাঠে কাজ করে যাচ্ছে সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। এডিস মশা নিধনসহ নানা সচেতনতামূলক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। ডেঙ্গু রোগী তা প্রতিকারের নানা দিক তুলে ধরে কর্মশালা, প্রশিক্ষণ, সেমিনারসহ নানা কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। সম্প্রতি অভিযানে রাজধানীর বিভিন্ন বাসাবাড়িতে গড়ে ১০০টি পাত্রের মধ্যে ১০টিতেই পাওয়া গেছে এডিসের লার্ভা। বেশ কয়েকটি এলাকার বাসাবাড়িতে উত্তর সিটি করপোরেশনের অভিযানে এ চিত্র বেরিয়ে এসেছে।

রাজধানীতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সম্প্রতি প্রকাশিত এক জরিপে জানা গেছে, গত বছরের তুলনায় এ বছর ডেঙ্গুর প্রজননস্থলের পরিমাণ বেড়েছে। রাজধানীর ২৩টি ওয়ার্ডেমশার ঘনত্ব পরিমাপের সূচক ব্রুটো ইনডেক্স ১০-এর বেশি পাওয়া গেছে। এসব এলাকার বিভিন্ন বাসাবাড়ি ও নির্মাণাধীন বিভিন্ন ভবনের ১০০টি মধ্যে ১০টি পাত্রে মিলেছে এডিসের লার্ভা। রাজধানীর দুই সিটির ৯৮টি ওয়ার্ডের ৩ হাজার ১৫০টি বাড়িতে পরিচালিত হয় এই জরিপ কার্যক্রম।

ম্যালেরিয়া নির্মূল ও এডিসবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. একরামুল হক সাংবাদিকদের বলেন, দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মাত্র ৩টি সাইটে আমরা ব্রুটো ইনডেক্স ২০-এর বেশি পেয়েছি। হাউস ইনডেক্স হিসাব করে দেখা গেছে, এটি ৪ দশমিক ৭৫ অর্থাৎ ৫ এর কাছাকাছি। আমাদের ধারণা এবার বর্ষা মৌসুম নগরবাসীর জন্য ডেঙ্গুরোগ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে।

কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেন, সম্ভাব্য যেসব পাত্রে এডিস মশা জন্মায় বা জন্মানোর সম্ভাবনা রয়েছে; সেই সব পাত্র অপসারণ করা সবচেয়ে বেশি জরুরি। বর্ষা শুরুর আগেই সিটি মেয়রদের উচিত কাউন্সিলরদের নিয়ে প্রতিটি ওয়ার্ডে, পাড়া-মহল্লায় ভাগ করে স্থানীয় সমাজকর্মী এবং যুব সমাজকে সম্পৃক্ত করে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে কাজ করা।

সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে ঢাকা উত্তর সিটির মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম বলেন, আমরা যেটা তথ্য পেয়েছি গত বছরের চেয়ে এবার ডেঙ্গু আরো বেশি ভয়ংকর হতে পারে। আমার কথা হলো, আমরা সাধ্য মতো চেষ্টা করব, যা যা করা দরকার আমার কাউন্সিলদের নিয়ে, সিটি করপোরেশনের সবাইকে নিয়ে তা করব।বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক ও প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, ডেঙ্গু রোগের বাহক এডিস মশা। এ মশার কামড়ে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয় মানুষ। এটি সহজে প্রতিরোধ করা সম্ভব। আমরা প্রতিদিন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী পাচ্ছি। তবে বর্তমানে এ রোগীর সংখ্যা বেড়ে গেছে। ডেঙ্গু রোগীরা উপযুক্ত চিকিৎসায় একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর সুস্থ হয়ে উঠছেন।

তিনি বলেন, প্রতি বছর জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ডেঙ্গুর প্রকোপ থাকে। এ বছর মৌসুমের আগেই প্রচুর বৃষ্টিপাত হচ্ছে। তাই ডেঙ্গুর আশঙ্কা থাকে বেশি। এজন্য প্রত্যেককে তার আশপাশ পরিষ্কার রাখতে হবে। কোথাও যেন বৃষ্টির পানি দীর্ঘ সময়ের জন্য জমে না থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।