সময়ের সাহসী মানুষ তাঁরা

সময়ের সাহসী মানুষ তাঁরা
জীবনের ঝুঁকি নিয়ে স্বেচ্ছায় করোনা শনাক্তকরণ ল্যাবে কাজ করছেন তাঁরা

সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে রূপ বদল করে ক্রমশই ভয়াবহ আকার ধারণ করছে করোনাভাইরাস। বারবার করোনার এমন ধরন পরিবর্তনে জনমনে বিরাজ করছে শঙ্কা। সর্বক্ষণ মানুষের মনের মধ্যে কাজ করছে অজানা এক ভীতি; মনে হয় এই বুঝি নেমে এলো মৃত্যুর ভয়াবহ নীরবতা। ঠিক এমনই এক পরিস্থিতিতে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবি) জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি (জিইবি) বিভাগ থেকে সদ্য স্নাতক সম্পন্ন করা শিক্ষার্থী রকিব ও সালমানদের মতো সময়ের কিছু সাহসীরা জগৎ সংসারে স্নেহ, প্রেম, সাহসিকতা আর ভালোবাসা পাশাপাশি ছড়িয়ে দিচ্ছে বলেই হয়তো মানুষ বাঁচে এবং বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখে। করোনা মহামারির শুরু থেকে স্বেচ্ছায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শাবিতে স্থাপিত করোনা শনাক্তের ল্যাবে কাজ করে যাচ্ছেন তাঁরা। করোনা শনাক্তকরণ ছাড়াও সিলেট অঞ্চলে করোনার ধরন, পরিবর্তন ও জীবন রহস্য নিয়ে গবেষণা করছেন শিক্ষক –শিক্ষার্থীদের নিয়ে গড়া স্বেচ্ছাসেবী এই দল।

করোনা শনাক্তে কাজ করা শিক্ষার্থীরা বলেন, আমাদের এখানে ল্যাব স্থাপন হবার পরে রমজান এবং কোরবানির ঈদ পার হয়েছে। আমরা গত দুই ঈদের দিনেও কাজ করেছিলাম। এবার ঈদের দিনও কাজ করেছি। ল্যাবের কাজে আমাদের যত চাপই হোক, এতে কিছু মনে করি না, আমরা চাই দ্রুত কাজ শেষ করে যেন মানুষকে দ্রুত তাদের রিপোর্ট দিতে পারি এবং রিপোর্ট পাবার পরে তারা যেন সেই অনুযায়ী চিকিৎসা নিতে পারে। 

গত বছর ১৮ মে বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন শাবিতে করোনা শনাক্তকরণ ল্যাব উদ্বোধন করেছিলেন। ল্যাব স্থাপনের পর থেকে ওই বিভাগের কিছু শিক্ষক ও গ্রাজুয়েটদের ২৫ জনের একটি স্বেচ্ছাসেবী দল নিয়মিত নমুনা শনাক্তে কাজ করছেন। ল্যাবে কাজ করা স্বেচ্ছাসেবী শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা হলেন,
অধ্যাপক ড. মো. শামসুল হক প্রধান, অধ্যাপক ড. আশরাফুল জাহান, সহকারী অধ্যাপক ড. অজিত ঘোষ, মো. হাম্মাদুল হক, জিয়াউল ফারুক জয়, জি. এম. নূরনবী আজাদ জুয়েল এবং মো. আক্কাস আলী, পিএইচডি ফেলো মো. নাজমুল হাসান, স্নাতক সম্পন্ন করা শিক্ষার্থী মো. রবিউল আওয়াল, হাফিজ আল আসাদ, অমিত কুমার মন্ডল, মোবারক করিম রাজু, মো. মাইনুল ইসলাম বকুল, মো. মোশাররফ হোসেন, মো. মহসিন বেপারী, অসীম দেবনাথ, মুমতাহিন আহমেদ, মেহেদী হাসান হৃদয়, সুদীপ্ত সাকিব দুরন্ত, রাহাতুল ইসলাম, মো. রকিব ওয়াজেদ নয়ন, সালমান আহমেদ, তাহসিন খান, মো. ফাহমিদ হোসাইন ভূঁইয়া, শাহরিয়ার আরিফিন, চক্রবর্তী দীপ্ত,  মশিউর রহমান, অভিষেক সরকার, আব্দুল কাদের রাহাত, মোখলেসুর রহমান শিপন, নাবিল দেবনাথ, মাহমুদুল হাসান, ল্যাবের সহকারী মো. সাদিকুর রহমান এবং মো. পয়েস মিয়া।

"শাবির করোনা ল্যাবে ছয় ধরনের পরিবর্তিত করোনাভাইরাসের জীবনরহস্য উন্মোচন“
বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবে করোনা শনাক্তের পাশাপাশি সিলেট অঞ্চলের করোনার নমুনা নিয়ে গবেষণা করে ছয় ধরনের পরিবর্তিত করোনাভাইরাসের জীবনরহস্য উন্মোচন করেছেন স্বেচ্ছাসেবী এই গবেষক দল। তাদের গবেষণায় পাওয়া করোনার নতুন ছয় ধরনের এই পরিবর্তন শনাক্ত বিশ্বে প্রথম৷ এছাড়া বাংলাদেশে প্রথম কিন্তু অন্যান্য দেশে আগে শনাক্ত হয়েছে এমন ২৪ ধরনের করোনার পরিবর্তন এবং জীবনরহস্যেরও উন্মোচন করেছেন তারা। তাদের গবেষণায় জিন বিন্যাস বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা করে পাওয়া তথ্যমতে, সিলেট বিভাগে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাসের সঙ্গে ইতালি, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ফিনল্যান্ড, জার্মানি, রাশিয়া, ভারত ও বাংলাদেশে পূর্বে পাওয়া করোনার সাদৃশ্য ছিল।স্বেচ্ছাসেবকরা জানান, এই জীবনরহস্য বা করোনার ধরন দেশে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাস সম্পর্কে জানতে ও ভাইরাসের ভ্যাকসিন তৈরিতে অধিকতর গবেষণায় কাজে আসবে।

জানা যায়, নমুনা সংগ্রহ ছাড়া নমুনা প্রক্রিয়াকরণ থেকে শুরু করে সেটাকে আরটি-পিসিআর মেশিনের সাহায্যে শনাক্তকরণ শেষে রেজাল্ট তৈরি করে জেলা সিভিল সার্জন অফিসে পাঠানো পর্যন্ত সকল কাজ এই স্বেচ্ছাসেবীরা নিজেরাই করে থাকেন। দেশের ক্রান্তিলগ্নে করোনা টেস্ট নিয়ে এতো এতো জালিয়াতির মাঝে স্বাস্থ্যসেবার অংশ না হয়েও শাবির ল্যাব এবং তাদের স্বেচ্ছাসেবীদের কাজ যেন মানুষের বাঁচার সাহস যোগায়। করোনা নমুনা পরীক্ষার পরিধি ঢাকার বাইরে প্রসার হলেও দুরূহ এই কাজটি সহজ হয়েছে স্বেচ্ছায় যুক্ত এমন তরুণ বায়োটেকনোলজিস্টদের চেষ্টায়। মানুষের হয়ে কাজ করার অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে তাঁরা বলেন, ল্যাবে কাজ করার পাশাপাশি স্বাস্থ্যবিধি মেনে আমরা নিজেরাই ফাঁকা ক্যাম্পাসে বসে আড্ডা দেই। মহামারির এই আতঙ্কের মাঝে মানুষের জন্য কাজ করতে পারছি এতেই আমাদের শান্তি। আমরা স্বপ্ন দেখি করোনামুক্ত সুন্দর পৃথিবীর।