সিলেটে প্রতিদিনই সড়কে ঝরছে প্রাণ

সিলেটে প্রতিদিনই সড়কে ঝরছে প্রাণ

সিলেটে ফের ভয়াবহ হারে বেড়েছে সড়ক দুর্ঘটনা। প্রায় প্রতিদিনই সিলেট বিভাগের সড়ক-মহাসড়কে ঘটছে ছোট-বড় দুর্ঘটনা। কোনো দুর্ঘটনায় যাচ্ছে একাধিক প্রাণ। মেনে নিতে হচ্ছে বীভৎস মৃত্যুর নিয়তিকে, রাস্তায় পড়ে থাকছে মানুষের ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন নিথর শরীর। অনেকে আবার সারা জীবনের জন্য সঙ্গী করছেন পঙ্গুত্বকে।

দুর্ঘটনার শিকার আহত ব্যক্তি ও সচেতন মানুষের বলছেন- ট্রাফিক আইনের যথাযথ প্রয়োগ না থাকায় সড়কে থামছে না লাশের মিছিল। 

সর্বশেষ বৃহস্পতিবার (২৯ ডিসেম্বর) ভোরে বিভাগের হবিগঞ্জের মাধবপুর ও আজমিরীগঞ্জে পৃথক দুর্ঘটনায় দুজনের মৃত্যু হয়েছে। 

জানা গেছে, হবিগঞ্জের মাধবপুরে ঘন কুয়াশায় দাঁড়িয়ে থাকা পিকআপ ভ্যানকে একটি ট্রাক ধাক্কা দিলে হাসের খামারি রহমত উল্লাহ (৫০) নিহত হয়েছেন। তিনি চুনারুঘাট উপজেলার তাউসী গ্রামের মৃত ছামির উদ্দিনের ছেলে। বৃহস্পতিবার ভোর রাতে সিলেট-ঢাকা মহাসড়কের নোয়াপাড়া এলাকায় এ দুর্ঘটনা ঘটে।

প্রায় একই সময়ে হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জে গাড়িচাপায় সুখেল মিয়া ছায়েদ (৩৫) নামে এক মানসিক প্রতিবন্ধী যুবকের মৃত্যু হয়েছে। ভোরে আজমিরীগঞ্জ-শিবপাশা সড়কের পাচাইক্কা নামক স্থানে এ দুর্ঘটনা ঘটে। নিহত ছায়েদ সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার শ্রীহাইলল গ্রামের নুর উদ্দিন মিয়ার ছেলে।

এর আগের দিন (২৮ ডিসেম্বর) বিভাগের প্রথক দুর্ঘটনায় সড়কে ৩ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। সিলেট-ঢাকা মহাসড়কের হবিগঞ্জের বাহুবল উপজেলার মিরপুর ফিলিং স্টেশন এলাকায় বুধবার ভোরে দুই ট্রাকের সংঘর্ষে রাজন মিয়া (২৭) নামে এক ট্রাক চালক নিহত হয়েছেন। নিহত চালক মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল থানার লালবাগ এলাকার বাসিন্দা।

এর আগের রাতে এক দুর্ঘটনায় দুজন প্রাণ হারান। মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে জেলার মাধবপুর উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা চত্বর এলাকায় পিকআপ ভ্যানের ধাক্কায় মোটরসাইকেলে থাকা দুই যুবক মারা যান। নিহতরা হলেন- মাধবপুরের বেজুড়া গ্রামের ইমাম হোসেনের ছেলে শুভ মিয়া (১৮) ও আফতাব হোসেনের ছেলে সোহাগ মিয়া (১৭)। সম্পর্কে তারা চাচাতো ভাই।

একই দিন সিলেটের দক্ষিণ সুরমার অকুস্থল হিসেবে পরিচিত রশিদপুরে আবারও ঘটেছে ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনা। বেলা ২টার দিকে বিআরটিসি বাস ও অক্সিজেন সিলিন্ডারবাহী পিকআপের মুখোমুখি সংঘর্ষে ঘটনাস্থলেই পিকআপ চালকের মৃত্যু হয়েছে। নিহতের নাম সাজন (২৮)। তিনি সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার বড়গুলা গ্রামের খুরশেদ আলীর ছেলে। এ দুর্ঘটনায় সাজনের চাচাতো ভাই তার সহযোগী নুরুল আমিন (১৮) গুরুতর আহত হয়েছেন। তাকে উদ্ধার করে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। 

এর আগে দিন (সোমবার) সিলেটের গোলাপগঞ্জে ট্রাকচাপায় মারা যান জবরুল ইসলাম (৪৫) নামে এক মোটরসাই‌কেল আরোহী‌। এদিন দুপুরের দিকে উপজেলার ফুলবাড়ি ইউনিয়নের সিলেট- জকিগঞ্জ সড়কের হিলালপুর নামকস্থানে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ঘটনাস্থ‌লেই মারা যান জবরুল ইসলাম। মারা যাওয়া জবরুল দক্ষিণ সুরমার কুচাই এলাকার দক্ষিণ পাড়া গ্রামের মৃত মসবুর আলীর ছেলে। 

স্থানীয় সূত্র জানায়, সিলেট থেকে গোলাপগঞ্জগামী দ্রুতগতির একটি ট্রাক সিলেটগামী মোটরসাইকেলকে (সিলেট-হ-১১-৯৮৬২) চাপা দেয়। এতে ঘটনাস্থলেই মোটরসাইকেল আরোহী জবরুল নিহত হন।  

এগুলো ছাড়াও সম্প্রতি বিভাগের বিভিন্ন সড়কে ঘটেছে বিভিন্ন ছোট-বড় দুর্ঘটনা। 

সিলেটে একের পর এক সড়কে প্রাণ ঝরলেও আইনের যথাযথ প্রয়োজন নেই বলে দাবি করছেন ‘নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা)’ সংগঠনের নেতৃবৃন্দ। তারা বলছেন- নিরাপদ সড়ক গঠনে ২০১৮ সালে প্রণিত আইনের সঠিক প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন অত্যন্ত প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে সর্বপ্রথমে সরকার, প্রশাসন ও রাজনৈতিক মহলের সদিচ্ছা প্রয়োজন। তা না হলে সড়কে লাশের দীর্ঘ মিছিল ঠেকানো সম্ভব নয়।

এ বিষয়ে ভোক্তভুগী ও বিশ্লেষকরা বলছেন- বেপরোয়া গতি, সড়কে বিপজ্জনক বাঁক, রোড মার্কিংয়ের অভাব, ফিডার রোড (পার্শ্ব রাস্তা) এবং অটোরিকশার দাপট সড়ক-মহাসড়কে দুর্ঘটনা বাড়ার মূল কারণ। এ পাঁচটির পাশাপাশি ট্রাফিক আইন যথাযথভাবে অনুসরণ না করা, গতিসীমা অনুসরণ না করা, মাত্রাতিরিক্ত যাত্রী বা মালামাল বহন করা, রোড সাইন, মার্কিং ও ট্রাফিক সিগন্যাল সম্পর্কে ধারণা না থাকা বা ধারণা থাকলেও তা মেনে না চলা, ওভারটেক, সামনের গাড়ির সঙ্গে নিরাপদ দূরত্ব বজায় না রাখা, ত্রুটিপূর্ণ গাড়ি চালানো, চালকের পরিবর্তে হেলপার দিয়ে গাড়ি চালানো, ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে গাড়ি চালানো, প্রয়োজনীয় বিশ্রাম না নিয়ে অবসাদগ্রস্ত অবস্থায় একটানা গাড়ি চালানো, নেশাগ্রস্ত অবস্থায় গাড়ি চালানো, শিক্ষার স্বল্পতা, অপর্যাপ্ত ট্রেনিং এবং অনভিজ্ঞতাও দুর্ঘটনার কারণ।

তবে এসব ‘অপরাধ’ ঠেকাতে সংশ্লিষ্টদের উদাসীনতাও লক্ষণীয় বলে দাবি করছে সচেতন মহল। এ বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে কঠোর হওয়া প্রয়োজন মনে করছেন সচেতন সিলেটবাসী।

‘নিসচা’র সিলেট মহানগর কমিটির সভাপতি এম ইকবাল হোসেন সিলেটভিউ-কে বলেন- ‘ নিরাপদ সড়ক গঠনে ২০১৮ সালে প্রণিত আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন অত্যন্ত প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে সর্বপ্রথমে প্রয়োজন সরকার, প্রশাসন ও রাজনৈতিক মহলের সদিচ্ছা। তারপর সড়কে চলাচলে চালক, মালিক, যাত্রী, পথচারী সবাইকে প্রশিক্ষণের আওতায় আনতে হবে।

তিনি বলেন- ২০১৮ সালের আইনে অনেক ফাঁকও রয়েছে। সেগুলো চিহ্নিত করে নীতিমালার দ্রুত সংযোজন প্রয়োজন। যেমন- আইনে রাস্তায় যানবাহনের ধরনভেদে কোন গাড়ির কত গতি হবে সে সম্পর্কে কোনো উল্লেখ নেই। মোটরসাইকেল চালকদের প্রতি হেলমেট মেইনটেইন ও পরিধানের কোনো নির্দেশনা না থাকায় শুধুমাত্র আইনের হাত থেকে বাঁচতে নি¤œমানের হেলমেট ব্যবহারিত হয়। শুধু চালককে সিটবেল্ট ব্যবহারে নির্দেশনা থাকায় যাত্রীদের সিটবেল্ট ব্যবহারে অনীহা প্রকাশ করেন। তাছাড়া ডোপ টেস্টের সঠিক ব্যবহার ও মনিটরিং না থাকায় এখনও অনেক চালক নেশাগ্রস্ত অবস্থায় গাড়ি চালনা করেন।

সড়ক দুর্ঘটনার কারণ ও দুর্ঘটনা রোধে করণীয় বিষয়ে হাইওয়ে পুলিশ সিলেট রিজিওনের এসপি (পুলিশ সুপার) মো. শহীদ উল্লাহ সিলেটভিউ-কে বলেন, উঠতি বয়েসি ছেলেরা রাস্তায় মোটরসাইকেল নিয়ে বের হয়। তাদের থাকে না লাইসেন্স। সঙ্গে থাকে না হেলমেট। রাস্তায় গতির প্রতিযোগিতা করে। ফলে অনাকাক্সিক্ষত দুর্ঘটনা ঘটে। অনেকেই মারা যান এমন দুর্ঘটনায়। রাস্তায় এমন বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানো দেখলে আমরা চালকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেই।

তিনি আরও বলেন, মহাসড়কে সিএনজিচালিত অটোরিকশা, ত্রি-হুইলার চলাচলের অনুমতি নেই। তবুও এসব গাড়ি মহাড়সকে চলে। এদের যানবাহন চালানোর লাইসেন্স নেই। পুলিশ দেখলেই গাড়ির গতি বেপরোয়াভাবে বাড়িয়ে পালিয়ে যেতে চায়। লাইসেন্সবিহীন এসব অদক্ষ ড্রাইভারের কারণে সড়ক দুর্ঘটনা বাড়ছে। তবে আমরা তাদের বিরুদ্ধে নিয়মিত মামলা দেই। আবার এসব অদক্ষ ড্রাইভারদের কারণে কারো মৃত্যু হলে আমরা তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করি।

হাইওয়ের এই পুলিশ সুপার বলেন, ট্রাফিক নিয়ম অনুযায়ী মহাসড়কে সর্বোচ্চ গতিসীমা ৮০ কিলোমিটার। কিন্তু সেটি অনেকেই মানেন না। বিশেষ করে কমবয়েসি মোটরসাইকেল চালকরা। আমরা তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আছি, আরও কঠোর হবো।

এসপি শহিদুল্লাহ আরও বলেন- অনেক সময় পথচারীদের ভুলের কারণেও সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। যে যেভাবে পারছে সড়ক পার হচ্ছে। আমরা সচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করছি। বিভিন্ন সময় সভা-সেমিনার করছি। চালক ও হেলপারদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। তবে সড়ক দুর্ঘটনা এড়াতে সবাই নিজ নিজ অবস্থান থেকে সচেতন হতে হবে এবং কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে।