সুনামগঞ্জের উন্নয়ন বনাম এমপিদের গ্রুপিং রাজনীতি

সুনামগঞ্জের উন্নয়ন বনাম এমপিদের গ্রুপিং রাজনীতি
লেখকের ছবি

বিগত দিনে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে সুনামগঞ্জ অনেক তারকা রাজনীতিবিদ উপহার দিলেও এবং উনারা সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রনালয়গুলোর দায়িত্বে থাকলেও সুনামগঞ্জের উন্নয়ন চিরাচরিত ভাবে প্রদীপের নীচের অন্ধকারের মতোই থেকে গেছে। 

বাংলাদেশের ইতিহাসে এবং রাজনীতিতে উনাদের অবদানের কথা আমরা যেভাবে মুখ চওড়া করে বলতে পারি উন্নয়নের কথা আসলে আমাদের মুখ ঠিক ততোটাই চুপসে যায়। অতীতে আমাদের সেই তারকা রাজনীতিবিদদের অতিমাত্রায় দলীয় গ্রুপিং রাজনীতির কারণে সমগ্র সুনামগঞ্জ বাসী উন্নয়ন থেকে বঞ্চিত হয়েছে। স্বাধীনতার পঞ্চাশতম বছরে এসেও আমরা উন্নয়নের মূল পূর্বশর্ত যোগাযোগ ব্যবস্থার কাঙ্খিত উন্নয়ন করতে পারিনি। এখনও জেলা সদরের সাথে সবগুলো উপজেলার সড়ক যোগাযোগ নেই। এখনও দিরাই-শাল্লার যোগাযোগের একমাত্র রাস্তাটি বাস্তবায়নের জন্য জনগণকে মানব বন্ধন করতে হয়! 

শুধু যোগাযোগ ব্যবস্থাই নয় সুনামগঞ্জ বাংলাদেশের অন্যসব জেলা থেকে সবদিকেই পিছিয়ে আছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার সরকার হাওড়াঞ্চলের উন্নয়নের ব্যাপারে আন্তরিক হওয়ায় এবং আমাদের সুনামগঞ্জের কৃতিসন্তান এম এ মান্নান সাহেবের মতো একজন সৎ, কাজ পাগল লোক পরিকল্পনা মন্ত্রনালয়ের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রনালয়ের দায়িত্বে থাকায় উন্নয়নের ব্যাপারে সুনামগঞ্জবাসীর মধ্যে আশার সঞ্চার হয়েছিল। এরই ধারাবাহিকতায় আমরা দেখলাম সুনামগঞ্জে মেডিকেল কলেজ, টেক্সটাইল ইন্সটিটিউটের মতো বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে।

শুধু তাই নয় সুনাগঞ্জবাসীর আজন্ম লালিত স্বপ্ন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ও প্রতিষ্ঠার জন্য অনুমোদন লাভ করেছে। রেলগাড়ী একদিন সুনামগঞ্জে আসবে এই স্বপ্নটি আমাদের প্রয়াত জাতীয় নেতা এবং বাংলাদেশের প্রথম রেলমন্ত্রী বাবু সুরঞ্জিত সেনগুপ্তই সুনামগঞ্জ বাসীকে দেখিয়ে গিয়েছিলেন এবং এ ব্যাপারে তিনি হয়তো কিছু কাজও করে গিয়েছিলেন। যোগাযোগ ব্যবস্থাসহ আরও অনেক কাজই এখনও করার বাকি।

জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী হিসেবে মান্নান সাহেব এইসব চলমান প্রকল্পের অগ্রগতি এবং সম্ভাব্য উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেওয়ার ব্যাপারে অত্যন্ত আন্তরিকভাবে কাজ করছেন। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে আমরা লক্ষ্য করছি সুনামগঞ্জ বাসীর আশা-আকাঙ্খা এবং স্বপ্নের উপর সুনামগঞ্জের পাঁচ এমপি এবং মন্ত্রীর মধ্যে গ্রুপিং যেন গোদের উপর বিষফোঁড়া হয়ে দাড়িয়েছে। সেই তারকা রাজনীতিবিদেরা ইহলোক ত্যাগ করলেও তাদের রেখে যাওয়া চ্যালা-চামুন্ডারা সবক্ষেত্রেই গ্রুপিং করার অভ্যাস ত্যাগ করতে পারেনি। এর নগ্ন প্রকাশ আমরা দেখতে পেয়েছি সুনামগঞ্জ বনাম শান্তিগঞ্জে বিশ্ববিদ্যালয়ের জায়গা নির্ধারণ করা নিয়ে। আমরা আশংকা করছি এই টানা হেচঁড়ায় না আবার বিশ্ববিদ্যালয় বাস্তবায়নের ফাইল হিমাগারে চলে গেছে!

কারণ এটা নিয়ে আর কোন দৃশ্যমান কাজ তো চোখে পড়ছে না। একই কায়দায় আবার শুরু হয়েছে রেল নিয়ে নোংরা রাজনীতি। পাঁচ এমপি বলছেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের প্রতি সম্মান দেখিয়ে উনার দেয়া এলাইনমেন্ট অনুযায়ী রেল লাইন ছাতক থেকে দোয়ারা হয়ে সুনামগঞ্জ যাবে আর পরিকল্পনা মন্ত্রী বলছেন রেললাইন সিলেট বা গোবিন্দগঞ্জ থেকে সোজাসুজি সনামগঞ্জ যাবে যার দরুন সুনামগঞ্জের বৃহৎ জনগোষ্ঠী রেল ব্যবহারের আওতায় আসবে। যে কোন অবকাঠামো সেটা রাস্তা, সেতু বা রেল লাইনই হোক সেটা তৈরি করা হয় বা এর পেছনে অর্থব্যয় করা হয় যাতে সর্বোচ্চ সংখ্যক জনগণ এর সুবিধাভুগী হতে পারে।  এজন্য পরিকল্পনা মন্ত্রীর দেওয়া এলাইনমেন্টই সুনামগঞ্জ জেলার সর্বোচ্চ সংখ্যক অধিবাসীকে রেল চড়ার আওতায় নিয়ে আসবে বলে আমি মনে করি। কারণ ছাতক শহর পর্যন্ততো রেল যোগাযোগ আছেই। সেটা ছাতক শহরবাসী এবং দোয়ারা উপজেলার লোকজন ব্যবহার করতে পারছেন

 ছাতক থেকে দোয়ারা হয়ে সুনামগঞ্জ এলাইনমেন্টে উত্তর ছাতক এবং দোয়ারাবাসী ছাড়া সুনামগঞ্জের অন্য কোন উপজেলার অধিবাসীরা রেল যোগাযোগের আওতায় আসছেন না। কিন্তু গোবিন্দগঞ্জ থেকে সোজাসুজি এলাইনমেন্টে ছাতক উপজেলার বৃহদাংশ, জগন্নাথপুর, দক্ষিন সুনামগঞ্জ, দিরাই, শাল্লা, জামালগঞ্জ অর্থাৎ মোটাদাগে সুনামগঞ্জ জেলার ৫-৬ টি উপজেলার জনগণ সহজে রেলগাড়ি চড়ার সুযোগ পাবে। কারণ সারা দেশের সাথে উপরোল্লেখিত উপজেলাগুলোর জনগণের যোগাযোগ এই এলাইনমেন্ট ধরেই। কাজেই সুনামগঞ্জের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে বঞ্চিত করে ছাতক-দোয়ারা দিয়ে সুনামগঞ্জের রেল সংযোগ কাম্য হতে পারে না। যেসব এমপিরা নিজের এলাকার জনগণের সুবিধার কথা চিন্তা না করে শুধুমাত্র গ্রুপিং টিকিয়ে রাখার জন্য ছাতক-দোয়ারা-সুনামগঞ্জ রেল লাইন বাস্তবায়নের জন্য একজোট হয়ে রেলমত্রী বরাবর চিঠি দিয়েছেন তারা প্রকৃতপক্ষে জনসেবক বা সেবিকা নন।

আমরা আশা করেছিলাম সকল এমপি মিলে মন্ত্রীর সাথে সমন্নয় করে নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকা তথা সমগ্র জেলার সার্বিক উন্নয়নে মনোনিবেশ করবেন। কিন্তু উনাদের যা কার্যক্রম দেখছি তাকে স্রেফ মন্ত্রীর বিরোধিতা করতে গিয়ে উন্নয়ন বিরোধিতা ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। তাই সুনামগঞ্জের বৃহত্তর জনগণের সুবিধার কথা ভেবে পরিকল্পনা মন্ত্রীর এলাইনমেন্ট অনুযায়ী রেল লাইন বাস্তবায়নের জন্য উপরোল্লেখিত উপজেলাগুলোর জনগণকে আন্দোলনে নামতে হবে।

আসি সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সম্মানের কথায়, আসলে রেল লাইন সুনামগঞ্জে নেওয়াই ছিল বাবু সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের স্বপ্ন, সেটা ছাতক-দোয়ারা দিয়েই হোক কিংবা অন্য কোনদিক দিয়েই হোক। তাই রেল লাইন সুনামগঞ্জে নেওয়া মানেই সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের প্রতি সম্মান দেখানো।

দিরাই-শাল্লার জনস্বার্থ বনাম এমপি
প্রতিটি নির্বাচনী এলাকার মানুষ তাদের জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত করে সংশ্লিষ্ট এলাকার অবকাঠামোসহ যাবতীয় উন্নয়ন তথা ঐ এলাকার জনস্বার্থে কাজ করার জন্য। তেমনি দিরাই-শাল্লার মানুষও ভোট দিয়ে ড: জয়া সেনগুপ্তকে এমপি বানিয়েছে দিরাই-শাল্লার জনস্বার্থে কাজ করার জন্য। কিন্তু আমাদের এমপি মহোদয় মনে হয় বর্তমানে দিরাই-শাল্লার মঙ্গলার্থে কাজ করা থেকে সুনামগঞ্জের গ্রুপিং রাজনীতিতে বেশি আগ্রহী এবং সক্রিয়। আমি জানিনা গ্রুপিং করে দলীয় বড় কোন পদ পদবী পাওয়ার অভিলাষ এই বয়সে উনার আছে কি না।

স্বভাবতই দিরাই-শাল্লার মানুষ আশা করেছিল উনি জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীর সাথে সদ্ভাব বজায় রেখে দিরাই-শাল্লার উন্নয়নে সর্বাধিক পরিমাণ কাজ আদায় করে নেবেন। কিন্তু আমরা তার উল্টোটাই লক্ষ্য করলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থান নির্ধারণ নিয়ে সুনামগঞ্জ বনাম শান্তিগঞ্জের টানাটানিতে উনি অন্যান্য এমপিদের পক্ষ নিলেন! কিন্তু তাতে দিরাই-শাল্লাবাসীর কি লাভ হল? উনি হয় দিরাই-শাল্লার কথা বলবেন নয়তো শান্তিগঞ্জের কথা বলবেন অথবা একেবারেই নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করবেন। কারণ সিলেটের সাথে দিরাই-শাল্লার আগামী দিনের যোগাযোগের রুট চিন্তা করলে শান্তিগঞ্জই আমাদের জন্য সুবিধাজনক হতো।

দিরাই-শাল্লাবাসীর সুবিধা অসুবিধার কথাতো বিবেচনায়ই নিলেন না উপরন্তু মন্ত্রীর সাথেও সম্পর্ক খারাপ করলেন। একইভাবে রেল লাইন নিয়েও তিনি বাকি চার এমপিদের সাথে মিলে ছাতক-দোয়ারা-সুনামগঞ্জ এলাইনমেন্ট বাস্তবায়নের চিঠিতে স্বাক্ষর করলেন। এক্ষেত্রেও তিনি দিরাই-শাল্লার জনস্বার্থের কথা বিবেচনা করেন নি। এই এলাইনমেন্টে রেল লাইন হলে দিরাই-শাল্লার মানুষ রেল সেবা থেকে পুরোপুরিই বঞ্চিত হবে। কারণ সিলেটের সাথে দিরাই-শাল্লাবাসীর আগামী দিনের সড়ক যোগাযোগ হবে দিরাই-টানাখালি-হোসেনপুর-ডাবর হয়ে সিলেট।

রেলে চড়ার জন্য দিরাই-শাল্লার মানুষ যতক্ষনে সুনামগঞ্জ যাবে ঠিক তৎক্ষণে সিলেট পৌছে যাবে। কাজেই দিরাই-শাল্লার জনগণের কথা বিবেচনা করলে আমাদের এমপি মহোদয়ের এই চিঠিতে স্বাক্ষর করার কথা নয়। ব্যক্তিগতস্বার্থে  গ্রুপিং করতে চাইলে করুন অসুবিধা নাই, কিন্তু দিরাই-শাল্লার জনগণের স্বার্থ জলাঞ্জলী দিয়ে গ্রুপিং করাটা এই এলাকার জনগণ প্রত্যাশা করে না।

লেখক
মো. সুমন চৌধুরী
সমাজকর্মী