পরিত্যক্ত থাকা সারদা হল ফিরছে পুরনো রূপে

পরিত্যক্ত থাকা সারদা হল ফিরছে পুরনো রূপে

প্রায় ১১ বছর পরিত্যক্ত অবস্থায় থাকার পর অবশেষে পুরনো রূপে ফিরছে সিলেটের ঐতিহ্যবাহী সারদাস্মৃতি ভবন। প্রায় ৮৬ বছরের পুরনো এই স্থাপনাটি আগামী ২১  সেপ্টেম্বর থেকে সংস্কৃতি চর্চার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হবে। এদিন থেকে সারদা হল মিলনায়তনে তিনদিন ব্যাপী নাট্য উৎসবের আয়োজন করবে সম্মিলিত নাট্য পরিষদ, সিলেট।

১১ বছর ধরে সারদা হলকে ভাগাড় হিসেবে ব্যবহার করে আসছিলো সিলেট সিটি করপোরেশন (সিসিক)। দীর্ঘদিন সিসিকের মালামাল  স্তুপ করে রাখায় নষ্ট হয়ে পড়ে এই ভবনের মঞ্চসহ পুরো মিলনায়তন। সংস্কৃতিকর্মীদের দাবির প্রেক্ষিতে এই ভবনটিকে পুরনো রূপে ফেরাতে সংস্কার কাজ করছে সিসিক।সিসিক সূত্রে জানা যায়, সংস্কার কাজের অংশ হিসেবে সারদা হল মিলনায়তনের মঞ্চ নতুন ভাবে নির্মাণ করা হয়েছে। ছাদে নতুন ঢালাই দেয়া হয়েছে। এখন চলছে রংয়ের কাজ। দুএকদিনের মধ্যে দর্শক সারির আসন বসানো হবে।

বুধবার বিকেলে সারদা হলের সংস্কাজ কাজ পরির্দশন করেন সিসিক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। এসময় তিনি ২১ সেপ্টেম্বর থেকে সারদা হল সংস্কৃতি চর্চার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়ার আশ্বাস দেন বলে জানান সম্মিলিত নাট্য পরিষদ, সিলেটের সভাপতি রজত কান্তি গুপ্ত।

রজত জানান, ২০ সেপ্টেম্বর সম্মিলিত নাট্য পরিষদ সিলেট ৪০ বছরে পদার্পণ করবে। এ উপলক্ষ্যে বছরব্যাপী অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করা হয়েছে। এর অংশ হিসেবে ২১ থেকে  ২৩ সেপ্টেম্বর হবে তিনদিনব্যাপী নাট্য প্রদর্শনী। সারদা হলেই এই প্রদর্শনীর আয়োজন করা হবে। এরআগে হলটির সংস্কার সম্পন্ন করার ব্যাপারে মেয়র আশ্বাস দিয়েছেন বলে জানান তিনি।

রজত বলেন, এই সংস্কার কাজের পরও সংস্কৃতি চর্চার জন্য আরো কিছু কাজ করতে হবে। মঞ্চে লাইট, সাইন্ড সিস্টেম ও পুরো হলে শীততাপ নিয়ন্ত্রন যন্ত্র বসাতে হবে। আমরা আশা করছি দ্রুততম সময়ে এগুলো সম্পন্ন হবে।

এই ভবনকে সংসাকৃতি চর্চার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়ার দাবিতে গতবছরের সেপ্টেম্বরে প্রতিবাদ সমাবেশ করেন সিলেটের সংস্কৃতিকর্মীরা। ওই সমাবেশে হাজির হয়ে সিসিক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী আশ্বাস দিয়েছিলেন, নভেম্বরের মধ্যে মিলনায়তনটি চালু করা হবে। তবে মেয়রের আশ্বাস সত্ত্বেও নভেম্বরে চালু হয়নি মিলনায়তনটি।  

তবে গত গত ফেব্রুয়ারিতে সারদা হল থেকে নিজেদের মালামাল সরিয়ে এটি সংস্কার কাজ শুরু করে সিটি করপোরেশন।

এ প্রসঙ্গে সম্মিলিত নাট্য পরিষদ সিলেটের সাধারণ সম্পাদক রজতকান্তি গুপ্ত বলেন, সারদা হল এই অঞ্চলের একটি ঐতিহ্যবাহী মিলনায়তন, যেটি কেবল সংস্কৃতি চর্চার জন্য একটি পরিবারের পক্ষ থেকে নির্মাণ করা হয়েছিল। অথচ এই ভবনটি দখল করে সিটি করপোরেশন তাদের পরিত্যক্ত মালামালের ভাগাড়ে পরিণত করেছিল। এছাড়া সারদা হল কমপ্লেক্স দখল করে বিভিন্ন সময়ে সিটি করপোরেশন ও রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি ভবন নির্মাণ করেছে।

রজত বলেন, আমরা দীর্ঘদিন ধরে সারদা হল সংস্কার করে এটি সংস্কৃতি চচর্’ার জন্য উন্মুক্ত করার দাবি জানিয়ে আসছি। একই সঙ্গে এই এলাকায় গড়ে উঠে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে একটি কালচালার কমপ্লেক্স নির্মাণেরও দাবি আমাদের।

জানা যায়, ১৯৩৬ সালে সিলেট শহরের সুরমা নদীর তীরের চাঁদনীঘাট এলাকায় নির্মিত হয় ‘সারদাস্মৃতি ভবন’। সংস্কৃতি চর্চার বিকাশে সিলেটের একটি ঐতিহ্যবাহী ব্যবসায়ী পরিবার ৩৯ শতক ভূমিতে কলকাতা ইউনিভার্সিটি ইন্সটিটিউটের আদলে এই মিলনায়তনটি নির্মাণ করে। এরপর থেকে সিলেটের প্রথম এই মিলনায়তনে গান, নাটকসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক ও সামাজিক অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়। পরবর্তীতে সিলেট পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনের ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হয়ে আসছে এ ভবনটি।

সিসিক সূত্র জানায়, সিলেট নগরীর বন্দরবাজার এলাকার পুরনো নগরভবন ভেঙ্গে নতুন ভবনের নির্মাণ কাজ শুরু হয় ২০১২ সালে। এসময় সুরমা নদীর তীরের তোপখানা এলাকায় সিটি করপোরেশন পরিচালিত ‘পীর হাবিবুর রহমান’ পাঠাগারে সিসিকের অফিস অস্থায়ীভাবে স্থানান্তর করা হয়। আর পাঠাগার বই এনে স্তুপ আকারে রাখা হয় সারদা হলের ভেতরে। এছাড়া হলের মূল ভবনের পাশের ছোট ভবনগুলোতে সিসিকের কয়েকটি দপ্তরের কার্যক্রম চালু করা হয়। সেসময় সিসিকের কর্মকর্তারা জানিয়েছিলেন, নতুন নগর ভবনের কাজ শেষ হওয়ার পর পুণরায় পীর হাবিবুর রহমান পাঠাগার চালু হবে এবং সারদা হল সংস্কৃতি চর্চার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে।

এরপর ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে সিসিকের নবনির্মিতের ভবনের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধনের পর স্থায়ী ভবনে নিয়ে আসা হয় সিসিকের কার্যক্রম। তবে স্থায়ী ভবনে আসার প্রায় সাড়ে তিন বছর পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত চালু হয়নি পীর হাবিবুর রহমান পাঠাগার। সারদা হলও সংস্কৃতি চর্চার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়নি। উল্টো এ ভবনে ভাগাড়ে পরিণত করেছে সিসিক।

এই ক’বছর সারদা হল কমপ্লেক্সের ভেতরে এবড়ো থেবড়োভাবে সিসিকের বিকল হয়ে যাওয়া গাড়িগুলো ফেলে রাখা হতো । পানির গাড়ি, বুলডোজারের যন্ত্রাংশও স্তুপ করে রাখা হতো আঙিনাজুড়ে। সিসিকের কয়েকজন কর্মচারীর আবাসন ব্যবস্থাও করা হয় এই চত্বরে। আর পীর হাবিবুর রহমান থেকে আনা বই দীর্ঘদিন থেকে হল রুমে স্তুপ করে ফেলে রাখার কারণে বেশিরভাগ বই-ই ইতোমধ্যে নষ্ট হয়ে গেছে। একসময়ের সিলেটের সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের এই পীঠস্থানটি আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হওয়ায় নষ্ট হয়ে পড়েছে পুরো মিলনায়তন।

সারদা হলের সংস্কার কাজের দায়িত্বে থাকা সিলেট সিটি করপোরেশনের নির্বাহী প্রকৌশলী সামসুল হক বলেন, দীর্ঘদিন ধরেই অব্যবহৃত থাকায় এই মিলনায়তনের অনেক কিছুই ব্যবহার অযোগ্য হয়ে পড়ে। মঞ্চের সব কাঠ নষ্ট হয়ে যায়। এগুলো সংস্কার করা হয়েছে।

এ ব্যাপারে সিলেট সিটি মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর বলেন, মূল স্থাপনা অবিকৃত রেখেই সারদা হলের সংস্কার কাজ করা হচ্ছে। দ্রুততম সময়ের মধ্যেই কাজ শেষ হবে। এরপর এটি পুরনো রূপে ফিরবে।