সিলেট গ্যাসফিল্ডে সিবিএ নেতাদের দৌরাত্ম্য

সিলেট গ্যাসফিল্ডে সিবিএ নেতাদের দৌরাত্ম্য

সিলেট গ্যাসফিল্ড লিমিটেডের ট্রান্সপোর্ট সুপারভাইজার মো. হারুন। তিনি সিবিএ সভাপতিও। অবসর প্রস্তুতিমূলক ছুটিতে (এলপিআর) গেছেন গত জানুয়ারিতে। কাগজপত্রে সরকারি বাসা ছেড়ে দিয়েছেন। তবে বাস্তবে ওই বাসায় অবস্থান করে সব সুবিধা নিচ্ছেন। সিবিএ আঞ্চলিক কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক ও গাড়িচালক আব্দুস সাত্তার। তাঁর নিয়ন্ত্রণাধীন একাধিক গাড়ি কোম্পানিতে ভাড়ায় ব্যবহার করা হচ্ছে। সিবিএ সাধারণ সম্পাদক ও ফোরম্যান আব্দুস সোবহানকে একাধিকবার পদোন্নতি দেওয়া হলেও গ্রহণ করেননি। কারণ সিবিএ নেতা থাকা পদোন্নতির চেয়ে অনেক মধুর। তাঁদের মতো একাধিক সিবিএ নেতা নানা সুবিধা নিচ্ছেন।

সিলেট গ্যাসফিল্ড লিমিটেড (এসজিএফএল) কার্যত নিয়ন্ত্রণ করছেন সিবিএ নেতারা। শুধু সুবিধা গ্রহণ নয়, তাঁদের বিরুদ্ধে বড় অভিযোগ নিয়োগ ও বদলি বাণিজ্য এবং বিরোধীদের নানাভাবে হয়রানির। নিয়মিত দায়িত্ব পালন না করে যখন-তখন কোম্পানির গাড়ি ব্যবহারেরও অভিযোগ উঠেছে তাঁদের বিরুদ্ধে। কোম্পানির অভ্যন্তরীণ নানা বিষয়ে তাঁরা নাক গলান। অথচ দৈনিক মজুরিভিত্তিতে কাজ করা শ্রমিকদের নিয়ে তাঁরা কথা বলেন না। পেট্রোবাংলার অধীন সিলেট গ্যাস ফিল্ডের প্রধান কার্যালয় জৈন্তাপুর উপজেলার চিকনাগুলে। বর্তমানে সিলেট গ্যাস ফিল্ডের অধীনে কৈলাসটিলা, গোলাপগঞ্জ, রশিদপুর, বিয়ানীবাজার গ্যাসফিল্ড রয়েছে। চার ফিল্ড মিলে ৬০০ কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন।

অভিযোগ উঠেছে, ২০২১ সালে দৈনিক মজুরিভিত্তিতে সিলেট গ্যাস ফিল্ড প্রধান কার্যালয়ের অধীনে ৭০ জন শ্রমিক নিয়োগের সময় ২-৩ লাখ টাকা করে হাতিয়ে নেন সিবিএ নেতারা। টাকা দেওয়ার পরও চাকরি পাননি অনেকে। এর মধ্যে স্থানীয় ঠাকুরেরমাটি এলাকার আবু হুরায়রা একজন। তিনি অভিযোগ করেন, ৩ লাখ টাকার মধ্যে ২ লাখ টাকা আগে দিয়েছিলেন। ১ লাখ টাকা চাকরি হওয়ার পর দেওয়ার কথা। কিন্তু চাকরি হয়নি, টাকাও ফেরত পাননি। গত ২৭ ফেব্রুয়ারি সহকারী ব্যবস্থাপকের ৯টি পদে নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। এ নিয়োগেও তদবির বাণিজ্য হবে এমন আশঙ্কা করছেন শ্রমিক-কর্মচারীরা।

এসজিএফএলে মায়া ট্রেডার্স ও স্পিডি করপোরেশন নামে দুটি প্রতিষ্ঠান গাড়ি সরবরাহ করে আসছে। এর মধ্যে মায়া ট্রেডার্সের সঙ্গে জড়িত সিবিএ আঞ্চলিক কমিটির (কৈলাসটিলা) সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুস সাত্তার। তিনি ও তাঁর ভাই মিলে গাড়ি সরবরাহ করে আসছেন। তাঁদের ৮-১০টি গাড়ি কোম্পানিতে আছে। সেগুলো ব্যবহারে নজরদারি করেন সাত্তার। অন্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও সিবিএ নেতারা জড়িত। এ বিষয়ে আব্দুস সাত্তার বলেন, মায়া ট্রেডার্স তাঁর ভাই আব্দুল আজিজের। কয়টি গাড়ি আছে তিনি জানেন না।

সিবিএ সহসভাপতি শহিদুল ইসলাম কোম্পানির বিভিন্ন কোটেশনের কাজ বাগিয়ে নেন। তাঁর ভাতিজা শাহজাহানকে দিয়ে ঠিকাদারি কাজ করান। সম্প্রতি বার্ষিক ক্রীড়া ও বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানের রঙের কাজ করেন শাহজাহান। অথচ কোম্পানির নিজস্ব ঠিকাদার এ কাজ করার কথা।

সিবিএ সভাপতি মো. হারুন দুই মাস আগে এলপিআরে যান। বাসা (কোয়ার্টার) ছাড়ার আবেদন করলে তা গ্রহণ করে কর্তৃপক্ষ। কিন্তু তিনি বাসা না ছেড়ে বসবাস করে আসছেন। গত ২৭ ফেব্রুয়ারি পে-স্লিপে দেখা গেছে, বেতনের সঙ্গে বাসা ভাড়া বাবদ ১৩ হাজার ৩৪৮ টাকা ছাড়াও অন্য সুবিধা গ্রহণ করেছেন। এ বিষয়ে মো. হারুন বলেন, জানুয়ারি থেকে আমি এলপিআরে আছি। কর্মচারীরা আমাকে সিবিএ সভাপতি হিসেবে থাকার অনুরোধ করছেন। তাই বাসা ছাড়িনি। কর্তৃপক্ষ বাসা ভাড়া চাইলে কর্তন করতে পারে। বদলি ও নিয়োগে সিবিএ নেতাদের কোনো হাত নেই দাবি করে তিনি বলেন, ওইসব কর্তৃপক্ষ করে। ৭০ জন ডে-লেবারের পক্ষে তাঁরা কথা বলছেন বলে দাবি করেন তিনি।

শ্রমিক-কর্মচারীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, ২০২০ সালে প্রথমবার সিবিএ নির্বাচনে জয়লাভের পর সর্বশেষ গত বছরের ২৮ ডিসেম্বর নির্বাচনেও জয়লাভ করে হারুন-সোবহান পরিষদ। জয়লাভের পর সিবিএতে নেই এমন নেতাদের নানাভাবে হয়রানি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ ওঠে তাদের বিরুদ্ধে। এরই অংশ হিসেবে গত ১৬ ফেব্রুয়ারি ৭ জনকে বিভিন্ন স্থানে বদলি করান তাঁরা। বদলি করা নেতাদের মধ্যে বশির আহমদ, ফকরুল ও ইলিয়াস আলী রয়েছেন।

এদিকে বদলিসহ বিভিন্ন দাবি নিয়ে আন্দোলন করছেন শ্রমিক ও কর্মচারীরা। এসব দাবি নিয়ে গত ২ মার্চ ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে আবেদনও দেন তাঁরা। দৈনিক মজুরিতে কাজ করা শ্রমিকদের বেতন থেকে ১০০ টাকা করে কেটে রাখেন ঠিকাদার আলাউদ্দিন। তিনি দৈনিক ভিত্তিতে কর্মরতদের মজুরি দিয়ে থাকেন পাশাপাশি ক্যান্টিন পরিচালনা করছেন। গ্যাস ফিল্ডের ক্যান্টিনটি তিনি ইজারা ছাড়াই পরিচালনা করছেন। সিবিএ নেতাদের সহযোগিতায় এসব করছেন আলাউদ্দিন। এ বিষয়ে আলাউদ্দিন জানান, ২০১৩ সালে তিনি টেন্ডারের মাধ্যমে ক্যান্টিন ইজারা নিয়েছেন। শ্রমিকদের টাকা কর্তন বিষয়ে বলেন, কমিশন হিসেবে সেই টাকা রাখি। কোম্পানি কোনো কমিশন দেয় না বলে দাবি করেন তিনি। তবে তিনি কোম্পানির কমিশন পাচ্ছেন।

জানা গেছে, গত দুই বছর ধরে দৈনিক মজুরিভিত্তিতে যাঁরা কাজ করে আসছেন তাঁদের ক্যাজুয়ালিটি আইডি প্রদান করা হয়নি। এমনকি ২০২০ সালে অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক আদেশে শ্রমিকদের মজুরি ৫০০-৫৫০ টাকা দেওয়ার নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু গ্যাস ফিল্ডের শ্রমিকরা ৪৮২ টাকা করে পাচ্ছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক শ্রমিক জানান, মজুরি কম দেওয়ার পাশাপাশি টাকা কর্তনও করছেন ঠিকাদার। তাঁরা জানান, হাবিব আহমদ ও অলি  নামের দুইজন অবসরে যাওয়ার পরও আবার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়েছেন। অথচ দৈনিক মজুরিভিত্তিক শ্রমিকদের বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না। তাঁরা জানান, সিবিএ নেতারা ইচ্ছামতো অফিস করেন। কোম্পানির গাড়ি নিজেদের কাজে ব্যবহার করছেন। তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয় না।

এদিকে কর্মচারীদের বদলি ও ৭০ জন শ্রমিকদের অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ দাবির বিষয়ে গত ২ মার্চ রাতে স্থানীয় রাজনীতিবিদ ও জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে বৈঠক করেন গ্যাস ফিল্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিজানুর রহমান। বৈঠকে প্রধান কার্যালয়ে কর্মরত স্থানীয়দের নিজ এলাকায় কর্মের সুযোগ, হয়রানিমূলক বদলি প্রত্যাহার, ৭০ জন দৈনিকভিত্তিক শ্রমিককে ২০১৬ সালের মতো ক্যাজুয়াল আইডি কার্ড ও প্রত্যয়নপত্র প্রদানসহ বিভিন্ন দাবি করা হয়।

এ প্রসঙ্গে মিজানুর রহমান জানিয়েছেন, দৈনিক মজুরিভিত্তিতে এখানে যাঁরা আছেন তাঁরা মূলত স্টাফ নন। তাদের মতো ৪ ফিল্ডে ২৬৪ জন শ্রমিক রয়েছেন। তাঁদের বিষয়টি বিবেচনায় রাখা হয়েছে। সিবিএ সভাপতির কোয়ার্টার না ছেড়ে সুবিধা নেওয়ার বিষয়ে খোঁজ নেবেন দাবি করে বলেন, সিবিএ নেতারা কোনো কাজে হস্তক্ষেপ করেন না। বদলি নিয়ম মেনে করা হয়।

জৈন্তাপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক লিয়াকত আলী বলেন, ‘স্থানীয়দের আন্দোলন ও বিভিন্ন দাবির বিষয়ে একমত হয়ে আমরা প্রশাসনের সঙ্গে বৈঠক করেছি। তাঁরা কথা দিয়েছেন দাবি পূরণের। কিন্তু গ্যাস ফিল্ডকে রাহুমুক্ত করতে না পারলে সমস্যা লেগেই থাকবে।’ -সমকাল