'আন্দোলন ও নির্বাচন দুটি কৌশলের খেলায় হেরেছে বিএনপি'

'আন্দোলন ও নির্বাচন দুটি কৌশলের খেলায় হেরেছে বিএনপি'

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে না গিয়ে বিএনপির কিছু লাভ হয়নি বলে সংবাদ প্রকাশ করেছে ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন বিবিসি বাংলা। গণমাধ্যমটি বলছে, তৃণমূল পর্যায় ভোটারদের চাহিদার কারণে বিএনপির বহু নেতা নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। যদিও বিশ জনেরও বেশি বিএনপি’র কেন্দ্রীয় এবং জেলা-উপজেলা পর্যায়ের নেতাকে দল থেকে বহিষ্কার করেছে বিএনপি। সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক মোজাম্মেল হোসেন মনে করেন, বিএনপির আন্দোলনটা ভুল লক্ষ্যের। তাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত ছিল নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করা, সরকার পতন নয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার যে সমাধান নয়, তা তো প্রমাণ হয়েছেই।

বিবিসি বাংলার প্রতিবেদনে বলা হয়, বিএনপি যখন সরকার পতনের আন্দোলনে নানা কর্মসূচি পালন করছে, তখন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বেশ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গেই এগিয়ে যাচ্ছে নির্বাচনের দিকে। একদিকে সরকার পতনের আন্দোলনে ব্যর্থতা অন্যদিকে নির্বাচনেও অংশ না নেয়া -বিএনপি তাহলে তাদের রাজনীতির কৌশল থেকে থেকে কী পেলো? এমন প্রশ্ন তুলেছে বিবিসি বাংলা।

নির্বাচন বর্জন নিয়ে বিএনপির ভেতরে অনেকের মধ্যেই ভিন্নমত আছে। যদিও এ বিষয়ে দলের কেন্দ্রীয় কিংবা তৃণমূল কোন পর্যায়ের নেতা-কর্মীরাই প্রকাশ্যে মুখ খুলতে চান না। তবে দলের কৌশলের বাইরে গিয়ে নিবাচনে অংশ নেয়া কিংবা নির্বাচনের পক্ষে কাজ করায় গেলো দেড় মাসে বিশ জনেরও বেশি বিএনপি’র কেন্দ্রীয় এবং জেলা-উপজেলা পর্যায়ের নেতাকে দল থেকে বহিষ্কার করেছে বিএনপি।

তাদেরই একজন সৈয়দ একে একরামুজ্জামান। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একটি আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ায় বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পদসহ দল থেকেই বহিস্কার করা হয় তাকে। সৈয়দ একরামুজ্জামানের মূল্যায়ন হচ্ছে, বিএনপির নির্বাচন না যাওয়ার কৌশল সঠিক নয়।

তিনি বলেন,“আমি দল থেকে বের হই নাই। আমাকেই তারা বহিষ্কার করেছে। আমার এলাকার ভোটারদের একটা চাহিদা আছে, সেখানকার একটা রাজনৈতিক বাস্তবতা আছে। সেজন্যেই আমি নির্বাচনে অংশ নিতে চেয়েছি।”বিএনপি’র আন্দোলনের কৌশল আরো নমনীয় হতে পারতো বলেও মনে করেন তিনি।

তিনি বলেন,“সরকার পতনের যে একদফা আন্দোলন এবং এর মধ্যে কোন সংলাপ নেই। কোন পক্ষেই নেই। কিন্তু বিএনপি থেকে যেসব শর্ত, আমার মনে হয়েছে আমরা একেবারে ‘পয়েন্ট অব নো রিটার্নে’ চলে গিয়েছিলাম। 'আওয়ামী লীগ তো বারবারই বলেছে যে তারা এর আগের মতো নির্বাচন এবার করবেন না এবং সুষ্ঠু নির্বাচনে বিদেশি চাপও ছিলো। সুতরাং এখানে দুটো পথ আছে -লড়াই করবো অথবা সরকারের উপর আস্থা রাখবো। আমার কাছে মনে হয়েছে, আরো একবার আস্থা কেন রাখবো না?”

রাজনীতি বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাশেদা রওনক খান মনে করেন, আন্দোলনের কর্মকৌশলেই ঘাটতি আছে বিএনপি’র। বিএনপি’র পলিটিক্যাল স্ট্রাটেজিতে তারা শুধু প্ল্যান এ নিয়েই এগিয়েছে। সেটা হচ্ছে, হরতাল-অবরোধ। কিন্তু এরপর কী? বিএনপি তো এর আগেও এরকম কর্মসূচি করেছে, যেটা কাজে আসেনি। আমার ‘প্ল্যান এ’ কাজ না করলে ‘প্ল্যান বি’ ফলো করবো। ‘বি’ না হলে ‘প্ল্যান সি’। কৌশলে তো একটা সময় পরিবর্তন আনতে হবে। কিন্তু বিএনপি যেন কোথায় আন্দোলন এবং নির্বাচন দুটোতেই কৌশলের খেলায় হেরে গেলো।”

রাশেদা রওনক খান মনে করেন দীর্ঘদিন নির্বাচন না করায় দলটির সামনে ভোটারদের থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার ঝুঁকিও তৈরি হয়েছে।

তিনি বলেন,“নির্বাচনে না আসা মানে অনেক ক্ষেত্রেই পিছিয়ে যাওয়া। একটা হচ্ছে ভোট ব্যাংককে হারিয়ে ফেলা। এটা অনেকভাবেই হতে পারে। ভোটারদের স্মৃতি থেকে হারিয়ে যাওয়া, প্রজন্ম থেকে হারিয়ে যাওয়া। কারণ নতুন প্রজন্ম ১৭ বছর ধরেই বিএনপিকে ক্ষমতায় দেখেনি।”

সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক মোজাম্মেল হোসেন মনে করেন, যে লক্ষ্য নিয়ে বিএনপির আন্দোলন চলছিল, সেটির সুযোগ তারা এরই মধ্যে হারিয়ে ফেলেছে। সরকার এখন কোনো চাপে নেই। তার বিবেচনায়, বিএনপির সামনে এখন কর্মসূচি পাল্টানো ছাড়া বিকল্প নেই। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “হরতাল- অবরোধকে নিরুপায় কর্মসূচি হিসেবে মনে হচ্ছে। তারা একটি অস্বাভাবিক অবস্থা তৈরির চেষ্টা করছে। কিন্তু অস্বাভাবিক অবস্থা তৈরি করে গণআন্দোলন হয় না।”

রাজনৈতিক বিশ্লেষক মোজাম্মেল হোসেন বলেন, “বিএনপি বারবার সময় বেঁধে দিয়ে একটা ভুল করেছে। এটা তাদের নেতৃত্বের অপরিপক্কতা বলে মনে করছি। ওমুক তারিখের মধ্যে এটা করে ফেলব, ওটা করে ফেলব, এসব বক্তব্য আসলে তাদের কর্মীদের মনোবলে শেষ পর্যন্ত চিড় ধরিয়েছে।আবার কোনো নির্বাচনে যাব না, সংলাপে যাব না, এটাও ছিল। এমন ‘না বোধক’ অবস্থান নিয়ে কোনো দল কখনও সফল হয়নি।”

নেতৃত্বের সংকট বিএনপিকে ভুগিয়েছে বলেও মনে করেন তিনি। বলেন, “তাদের চেয়ারপারসন সাজাপ্রাপ্ত এবং বন্দি। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান সাজা পেয়ে বিদেশে অবস্থান করছেন। তাদের (বিএনপি) দেশে একটি কার্যকর নেতৃত্ব তৈরি করা উচিত ছিল। লন্ডনে অবস্থানকারী তারেক রহমানের নেতৃত্ব বিএনপির জন্য দুর্বলতা। সক্রিয় কর্মীরা তাকে জিন্দাবাদ দিতে পারে, কিন্তু জনগণের সমর্থন তার ওপর থাকার কথা না।”

তিনি আরও  বলেন, “বিএনপির আন্দোলনটা ভুল লক্ষ্যের। তাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত ছিল নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করা, সরকার পতন নয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার যে সমাধান নয়, তা তো প্রমাণ হয়েছেই। আমাদের দলগুলো ক্ষমতার বাইরে থাকলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার চায়, আর ক্ষমতায় গেলে এটা চায় না বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে প্রভাবিত করতে চায়, তা তো দেখেছি।”

নির্বাচনে যাওয়ার লক্ষ্য একমাত্র ক্ষমতায় যাওয়া, এটাও মনে করেন না এই বিশ্লেষক। তিনি বলেন, “গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচন করলে ক্ষমতায় যেতেই হবে, এটা ভুল। বিরোধী দলে থাকাও তো ক্ষমতাকাঠামোর অংশ। জনগণ অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন চায়, তারা স্বাধীনভাবে ভোট দিতে চায়, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু তারা রাস্তায় নেমে গুলি খেয়ে সরকার পতন চায় না।”

কুমিল্লা উত্তরের বিএনপি কর্মী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সানজিদা খানম টানা কর্মসূচির বিপক্ষে। তিনি বলেন, “এভাবে অবরোধ কর্মসূচির কোনো মানে হতে পারে না। এটার বিরতি দেওয়া প্রয়োজন। বিএনপিকে নির্বাচন মাঠ থেকে সরিয়ে নির্বাচন করবে এটা দেশের অনেক মানুষ আগে থেকে ভেবেছে। কিন্তু এর বিপরীতে বিএনপিরও একাধিক কৌশল ঠিক করা উচিত ছিল। অর্থাৎ ‘প্ল্যান এ‘, ‘প্ল্যান বি’ ও ‘প্ল্যান সি’। প্ল্যান এ’ কাজ না করলে পরের বিকল্প পরিকল্পনায় যাওয়া যেত। তার বিচেনায় সেটি না থাকায় এখন দল ভুগছে। এখন কী দেখছি? সরকার নির্বাচনের সব প্রক্রিয়া করে যাচ্ছে আর বিএনপি অবরোধে পড়ে আছে। এতে করে নির্বাচন তো আর ঠেকানো যাচ্ছে না।”